
গণমাধ্যম সমাজের দর্পণ। এটি যেমন জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে, তেমনি সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো বৈচিত্র্য, সাম্য ও মানবাধিকারের প্রশ্নে সত্যনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও সংবেদনশীল প্রতিবেদন প্রকাশ করা। জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতা এই বৃহত্তর নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বর্তমানে নারী, তৃতীয় লিঙ্গ এবং অন্যান্য লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষ সমাজে নানা ধরনের বৈষম্য, নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হন। সাংবাদিকতা যখন এই বৈষম্যগুলোকে তুলে ধরার পরিবর্তে তা আরও তীব্র করে তোলে, তখন সেটি সমস্যার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, সাংবাদিকতা যদি জেন্ডার সংবেদনশীল হয়, তবে সেটি সমাজ পরিবর্তনের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতা হলো এমন একটি পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে সংবাদ সংগ্রহ, লেখা, উপস্থাপন এবং বিশ্লেষণের প্রতিটি পর্যায়ে লিঙ্গ বৈচিত্র্য, সমতা ও মর্যাদার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। এটি কেবল পুরুষ-নারী বিভাজনের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সকল লিঙ্গ পরিচয় ও অভিজ্ঞতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই ধরনের সাংবাদিকতা সমাজে প্রচলিত লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, সহিংসতা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে চায়। জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতা তথ্য উপস্থাপন করে এমনভাবে, যা কাউকে অপমান করে না, লিঙ্গ পরিচয়কে হাস্যরসের বিষয় করে তোলে না, এবং যা নারীর কিংবা অন্যান্য লিঙ্গ পরিচয়ের ব্যক্তির প্রতি অবমাননাকর ভাষা বা দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে না।
বাংলাদেশসহ অনেক দেশে গণমাধ্যমে জেন্ডার সংবেদনশীলতা এখনো পুরোপুরি গৃহীত হয়নি। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টাল এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও আমরা প্রায়ই দেখি। ভিকটিম-ব্লেমিং-ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার ঘটনার বর্ণনায় অনেক সময় ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করা হয়। তার পোশাক, চলাফেরা বা নিয়ম না মানার বিষয় তুলে ধরা হয়। ক্লিকবেইট শিরোনাম ও যৌন উত্তেজক উপস্থাপনা। নারীর শরীর বা যৌনতা নিয়ে চটকদার শিরোনাম, ছবি বা ভিডিও ব্যবহার করা হয় যা মূল বিষয় থেকে পাঠক/দর্শককে অন্যদিকে আকর্ষণ করে। তৃতীয় লিঙ্গ/হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করা হয়। এখনও অনেক সংবাদমাধ্যমে উভলিঙ্গ, হিজড়া সমস্যা বা পুরুষ-না-নারী-না ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয় যা গভীরভাবে অসম্মানজনক। নারীর সফলতাকে পারিবারিক অবদানের মাধ্যমে খাটো করা হচ্ছে। একজন নারী যখন কোনো ক্ষেত্রে সফল হন তখন সেটিকে তাঁর স্বামী বা পরিবারের সহযোগিতার ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।
তাই জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতা বাস্তবায়নে আমাদের বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিতে হবে। সাংবাদিকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সংবাদ কর্মীদের জেন্ডার বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। কীভাবে লিঙ্গ বৈষম্য ঘটে কোন শব্দগুলো অবমাননাকর বা স্টেরিওটাইপ তৈরি করে এসব বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা দরকার। জেন্ডার-বিষয়ক নীতিমালা মেনে চলার জন্য নিউজরুমে একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা উচিত। আমাদের ভাষা ও উপস্থাপনা সচেতন হতে হবে। সংবাদে কোন শব্দ ব্যবহারে নারীর প্রতি অবমাননা হবে সেটি ত্যাগ করতে হবে। সংবাদ পরিবেশনে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ভাষা ব্যবহার করা উচিত। যেমন-অভিযুক্ত ব্যক্তি বলা যেতে পারে ধর্ষক, ধর্ষিতার ছবি প্রকাশ না করা যেতে পারে। আমরা প্রায়ই সময় দেখি দোষী প্রমাণিত না হওয়ার আগেই ধর্ষক, হত্যাকারী, মাদক ব্যবসায়ী, পতিতা, চোর, ডাকাত ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়। এসব শব্দ দোষী প্রমাণ সাপেক্ষে উপস্থাপন করা যেতে পারে।
আবার অন্য দিকে নারী চিকিৎসক বা মহিলা ইঞ্জিনিয়ার বলার পরিবর্তে শুধু চিকিৎসক বা ইঞ্জিনিয়ার বলে সংবাদে উপস্থাপন করলে উহা শ্রুতিমধুর ও যথার্থতা প্রকাশ প্রায়। লিঙ্গ বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদমাধ্যমে নারী, তৃতীয় লিঙ্গ, লিঙ্গ-বিচারভিত্তিক সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। টক শো, সাক্ষাৎকার, প্যানেল আলোচনায় শুধু পুরুষদের না এনে নারী ও অন্যান্য লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদেরও সমান সুযোগ দিতে হবে। প্রসঙ্গভিত্তিক গভীরতর বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে হবে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি বা বৈষম্যের ঘটনাগুলো কেবল ঘটনাভিত্তিক না করে তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আইনি প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে পরিবেশন করতে হবে। নারী ও লিঙ্গ সংখ্যালঘুদের সাফল্য, সংগ্রাম ও অবদান নিয়েও নিয়মিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। যে কোনো মিডিয়ায় সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।
অনেক সময় সাংবাদিক সঠিক রিপোর্ট তৈরি করলেও সম্পাদকীয় পর্যায়ে সেটি পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাই সম্পাদকদেরও এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সংবেদনশীল হতে হবে। সাংবাদিকদের লেখা রিপোর্টে কেউ যদি জেন্ডারবিরোধী উপাদান টেনে আনেন, সেটি যেন সম্পাদনা করে অপসারণ করা হয়। নৈতিকতা ও মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে কাজ করতে হবে। সাংবাদিকদের উচিত ‘ডু নো হার্ম’ নীতিতে বিশ্বাস রাখা। কোনো সংবাদের ফলে যেন ভুক্তভোগীর দ্বিতীয়বার ক্ষতি না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সবার মর্যাদা ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য সাংবাদিকদের প্রতিটি শব্দ, ছবি ও ব্যাখ্যার প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে।
যে কোনো ঘটনা বিশ্লেষনে ইতিবাচক হতে হবে। তবে আশার আলো হলো-বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যম ইতোমধ্যে জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতার দিকে ধাবিত হয়েছে। যেমন : প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র (ইঘঔঈ) জেন্ডার সচেতনতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিছু অনলাইন পোর্টাল নারী নেতৃত্ব, কর্মজীবী নারীর সংগ্রাম উদ্যোক্তাদের জীবন-জীবিকা ও তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তৃতীয় লিঙ্গ শব্দ না লিখে হিজড়া, মহিলা শব্দ না লিখে নারী শব্দে বদলে ফেলা হয়েছে অনেক পত্রিকায়।
একজন সাংবাদিক কেবল তথ্য পরিবেশনের কাজ করেন না; তিনি সমাজ গঠনেরও অংশ। একজন সত্যনিষ্ঠ ও সংবেদনশীল সাংবাদিক সমাজে ইতিবাচক আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেন। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে এবং নীতিনির্ধারণে সাংবাদিকতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতা কেবল একটি নৈতিক দাবি নয়, এটি মানবিকতার এবং পেশাগত দায়িত্বের অংশ। সাংবাদিকদের উচিত লিঙ্গ বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, সংবেদনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা। এর মাধ্যমে গণমাধ্যম সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে এবং একটি অধিকতর ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে অবদান রাখতে পারবে।
লেখক পরিচিতি : উজ্জ্বল হোসাইন, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স (ব্যাচ-২০২১), প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ।
আপনার মতামত লিখুন