স্বপ্নপুরীর রাজা ও কাল্পনিক প্রেমের গল্প
পনেরো বছরের কিশোর রোহান ছিল গ্রামাঞ্চলের একজন সাধারণ ছেলে। প্রতিদিনের মতো সেদিনও বিকেলে সে তার প্রিয় বাঁশি নিয়ে গ্রামের পাশের বনের ধারে গিয়ে বসেছিল। আকাশ লালচে হয়ে গিয়েছিল, পাখিরা ফিরছিল তাদের নীড়ে। হঠাৎ করেই তার চোখে পড়ল এক বর্ণিল আলো। গাছপালার ফাঁক দিয়ে আলোটা ঠিক যেন কোনো সোনার বাক্স থেকে বেরিয়ে আসছিল। রোহান কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গেল।
অবাক হয়ে সে দেখল, বনের মাটিতে একটা ছোট, চকচকে বাক্স পড়ে আছে। বাক্সটা খুলতেই ঝলমলে আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক ছোট্ট, মায়াবী প্রাণী। প্রাণীটি বলল, “আমি স্বপ্নপুরীর দূত। তুমিই আমাদের রাজ্যকে রক্ষা করতে পারবে।”
রোহান কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রাণীটি তাকে হাত ধরে টেনে এক ঝলমলে গুহার দিকে নিয়ে গেল। গুহার ভেতর ঢুকতেই চারপাশ বদলে গেল। রোহান নিজেকে আবিষ্কার করল এক অদ্ভুত জায়গায়—স্বপ্নপুরী। এটি ছিল এক রঙিন রাজ্য যেখানে সবকিছুই স্বপ্নের মতো সুন্দর। কিন্তু এখানকার বাসিন্দাদের মুখে ছিল গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ।
প্রাণীটি জানাল, স্বপ্নপুরীর রাজা কোনো অজ্ঞাত শক্তির কারণে ঘুমিয়ে পড়েছেন। যদি তিনি জাগ্রত না হন, তবে স্বপ্নপুরী ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের একমাত্র ভরসা তুমি।
রোহান প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। সে তো একজন সাধারণ ছেলে, রাজাকে জাগানোর মতো কাজ কীভাবে করবে? কিন্তু প্রাণীটির অনুরোধে এবং স্বপ্নপুরীর বাসিন্দাদের দুঃখ দেখে সে সাহস সঞ্চয় করল। তাকে বলা হলো, রাজাকে জাগানোর জন্য “জীবনের ফুল” আনতে হবে। ফুলটি স্বপ্নপুরীর পূর্ব প্রান্তে থাকা কালের গুহাতে রয়েছে।
প্রাণীটি তাকে একটি যাদুর মানচিত্র দিল, যা তাকে সঠিক পথে নিয়ে যাবে। রোহান যাত্রা শুরু করল। পথে তার সঙ্গে যুক্ত হলো আরও কিছু সাহসী বাসিন্দা—টুকু, একজন কথা বলা কাক; মিষ্টি, এক ছোট্ট মেয়ে, যার হাসি মানুষকে শক্তি দেয়।
যাত্রার পথে তাদের প্রথম বাধা আসে এক ধোঁয়াশার জঙ্গলে। জঙ্গলটি ছিল প্রহরীদের দ্বারা সুরক্ষিত, যারা কেবল ধাঁধার উত্তর দিতে পারলেই পথ ছাড়ত। রোহান এবং তার সঙ্গীরা মিলে ধাঁধাগুলোর উত্তর দিল।
প্রহরী একবার জিজ্ঞাসা করল : যে জিনিসটি যত বেশি নেওয়া হয়, তত কমে যায়। সেটি কী?
রোহান উত্তর দিল, শ্বাস।
প্রহরীরা তাদের পথ ছেড়ে দিল।
এরপর তারা পৌঁছাল এক ভাঙা সেতুর কাছে। সেতু পার হতে হলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। রোহান সবার সঙ্গে সমন্বয় করে সেতু মেরামত করল। এই কাজ করতে গিয়ে তারা বুঝল, দলবদ্ধভাবে কাজ করলে বড়ো বড়ো বাধাও অতিক্রম করা যায়।
অবশেষে তারা কালের গুহার প্রবেশদ্বারে পৌঁছাল। কিন্তু সেখানে অপেক্ষা করছিল এক বিশাল দৈত্য। দৈত্যটি বলল, যদি আমার তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারো, তবে আমি তোমাক রাজ্য দান করবো।…..
অরণী ও আদ্রিত—দুজনের জীবন একদম ভিন্ন জগৎ থেকে শুরু। অরণী শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী, আর আদ্রিত পেশায় একজন চিত্রশিল্পী। অরণীর বইয়ের প্রতি ভালোবাসা, আর আদ্রিতের রঙের প্রতি নেশা তাদের দুজনকে ভিন্ন ভিন্ন পথে নিয়ে চলেছে।
তবে এক বিকেলে, বৃষ্টির পর আকাশে যখন রোদ মেখে উঠেছিল, ঠিক তখনই তাদের প্রথম দেখা। অরণী ক্যাম্পাসের পাশের পুরোনো বইয়ের দোকানে একটা কবিতার বই খুঁজছিল। বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ তার হাত গিয়ে ছুঁল আরেকটি হাতে। “সরি!” বলে মুখ তুলে তাকাতেই অরণী দেখতে পেল আদ্রিতের মায়াময় চোখ।
আদ্রিত তখন একটু হাসল। “আপনি কি হিউগো-র কবিতা পড়তে চান?”
অরণী হেসে বলল, “হ্যাঁ, তবে এই কপিটা হয়তো আপনার আগে আমি ধরেছি।”
সেই ছোট্ট হাসির বিনিময়েই শুরু হয়েছিল তাদের গল্প।
আদ্রিত আর অরণীর মধ্যে একটা অদ্ভুত সংযোগ তৈরি হয়েছিল। ফোন বা মেসেজ নয়, তারা চিঠি লিখত একে অপরকে। পুরোনো দিনের কাগজে কালির গন্ধে ভরা চিঠি। অরণী লিখত নিজের অনুভূতি, পড়া কবিতা, আর দিনযাপনের কথা। আদ্রিত তার জবাবে আঁকত কিছু স্কেচ, কিছু কবিতা, আর নিজের চিত্রশিল্পের ভাবনা।
চিঠিগুলো হয়ে উঠেছিল তাদের হৃদয়ের আয়না। প্রতিটি বাক্যে ছিল নতুন অনুভূতির স্পর্শ।
তাদের জীবনে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন আদ্রিত জানাল, তাকে অন্য শহরে যেতে হবে একটা বড় আর্ট এক্সিবিশনে। “এটা আমার স্বপ্ন পূরণের সুযোগ, অরণী। কিন্তু আমি জানি, এই দূরত্ব আমাদের গল্পকে কঠিন করে তুলবে।”
অরণী মুচকি হেসে বলল, “তোমার স্বপ্ন আমারও স্বপ্ন, আদ্রিত। চিঠিগুলোই তো আমাদের কাছে থাকছে। দূরত্ব কিছুই নয়।”
তবে বাস্তবতা সবসময় গল্পের মতো সুন্দর নয়। দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের চিঠির সংখ্যা কমে এলো। আদ্রিত কাজের চাপে ডুবে গেল, আর অরণীর মন কিছুটা ভারী হয়ে উঠল।
একদিন, কয়েক মাস পরে, অরণী একটি চিঠি পেল। খামের উপর আদ্রিতের হাতের লেখা। ভিতরে শুধু একটি বাক্য:
“যদি সময়ের সঙ্গে সব বদলে যায়, তবে কি ভালোবাসাও বদলে যায়?”
অরণীর হাত কাঁপছিল। চিঠির সঙ্গে ছিল একটি ছোট্ট পেইন্টিং—একটি মেয়ে, যার চোখে অশ্রু। অরণী বুঝতে পারল, আদ্রিত হয়তো এই গল্পের ইতি টানতে চাইছে।
কয়েক মাস কেটে গেল। অরণী নিজেকে কাজ আর পড়াশোনায় ডুবিয়ে রাখল। তবে একদিন হঠাৎ ক্যাম্পাসে একটি আর্ট গ্যালারির পোস্টার দেখতে পেল। “আদ্রিতের একক প্রদর্শনী।”
অরণী দ্বিধা নিয়েই প্রদর্শনীতে গেল। দেয়ালে ঝুলানো প্রতিটি ছবির মাঝে নিজের আর আদ্রিতের গল্পের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেল। একটি ছবির সামনে থেমে গেল সে—ছবিতে ছিল তার মুখ। নিচে লেখা ছিল : আমার চিঠির শেষ বাক্য।
পেছন থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এলো, “তুমি কি জানো, শেষ বাক্যটা তখনো অসম্পূর্ণ ছিল।
অরণী ঘুরে দেখল, আদ্রিত দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখে চোখ পড়ল, আর বুঝতে পারল, কিছু গল্পের সত্যি কোনো শেষ হয় না।
তাদের গল্প আবার নতুন করে শুরু হলো। ভালোবাসা সময়ের সঙ্গে বদলায় না, বরং সময় তার গভীরতা বাড়ায়। চিঠির শেষ বাক্যও নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে।
নিশ্চয়ই! গল্পটি আরও বিস্তারিতভাবে প্রসারিত করছি। নিচের অংশে তাদের জীবনের নানা নতুন মোড়, সম্পর্কের গভীরতা, এবং কাহিনির উত্তেজনা যোগ করছি।
আদ্রিত আর অরণী দেখা করার পর তাদের কথোপকথন শুরু হলো এক অদ্ভুত জড়তা নিয়ে।
“তুমি কীভাবে এতদিন আমার খোঁজ নাওনি?” অরণী প্রশ্ন করল।
আদ্রিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি চেয়েছিলাম তোমার জন্য কিছু হয়ে উঠতে, অরণী। কিন্তু যতই নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটেছি, ততই তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছি। অরণীর চোখে পানি চলে এল। তুমি ভাবলে, দূরে সরে গিয়ে আমাকে সুখী করতে পারবে? ভালোবাসা তো একসঙ্গে লড়াই করার জিনিস। দূরত্ব তৈরি করার নয়।
তাদের কথোপকথন চলতে থাকল। গ্যালারি থেকে বের হয়ে তারা বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে লাগল। পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠল দুজনের মনে।
সেদিনের পর তারা নতুন করে কথা বলা শুরু করল। তবে এবার তাদের সম্পর্কের ভিত আরও গভীর ছিল। আগের মতো চিঠি লিখতে শুরু করল তারা। চিঠির ভাষা আরেকটু পরিণত হলো। এখন শুধু অনুভূতির কথা নয়, ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা হতে লাগল।
আদ্রিত বলল, আমাদের এই গল্পটা যেন কোনো দিন অসমাপ্ত না হয়। আমি আর তোমাকে হারাতে চাই না।
অরণী মুচকি হেসে বলল, তাহলে একটা প্রতিজ্ঞা কর। আমাদের গল্পটাকে এবার থেকে একসঙ্গে লিখব।
তাদের সম্পর্ক যখন ভালোই চলছিল, তখন এক নতুন সমস্যা দেখা দিল। আদ্রিতের আর্ট গ্যালারির জন্য একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান তার কাজ নিয়ে আগ্রহ দেখাল। তবে শর্ত ছিল, তাকে অন্তত দুই বছরের জন্য বিদেশে থাকতে হবে।
আদ্রিত বিষয়টি অরণীকে জানাল। তুমি কি মনে কর, আমি এই সুযোগ গ্রহণ করলে আমাদের গল্পে আবার দূরত্ব আসবে?
অরণী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, দূরত্ব গল্প বদলে দিতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার গভীরতা থাকলে গল্পটা কখনো শেষ হয় না। তুমি যাও। আমি অপেক্ষা করব।
বিদেশে থাকা অবস্থায় আদ্রিত প্রতিদিন ভিডিও কল করত, চিঠি লিখত। কিন্তু দূরত্বের কারণে মাঝে মাঝে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হতো।
একদিন, আদ্রিত বলল, তুমি জানো, তোমার না থাকাটা আমাকে কীভাবে একা করে দেয়?
অরণী মৃদু হেসে বলল, তুমি হয়তো দূরে আছ, কিন্তু তোমার প্রতিটি চিঠি আর প্রতিটি কথা আমাকে বলছে, তুমি এখনো আমারই সঙ্গে আছ।
এই ধৈর্য আর ভালোবাসার সঙ্গে তারা দুই বছর পার করে ফেলল।
দুই বছর পর, এক বিকেলে অরণী একটি চিঠি পেল। চিঠির সঙ্গে একটি বিমানের টিকিট আর একটি নোট ছিল :
তোমার কাছে আর ফিরে আসছি না। এবার তোমাকে আমার কাছে আনতে চাই। এই টিকিটটা তোমার জন্য।
অরণী বিমানে চড়ে আদ্রিতের কাছে গেল। তাকে দেখে আদ্রিত বলল, “আমি হয়তো দূরে থেকে অনেক ভুল করেছি, কিন্তু এবার আর তোমাকে কোনো দিন একা রাখব না।”
তাদের গল্প এবার সত্যিই পূর্ণতা পেল। চিঠির শেষ বাক্যটি আর কোনো প্রশ্নে শেষ হলো না, বরং তা হয়ে উঠল একটি প্রতিজ্ঞার প্রতীক।
ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না, তা শুধু রঙ, শব্দ আর অনুভূতির ভিন্নতায় ধরা দেয়।
এভাবেই রোহান আর অরণীর গল্প সময়ের পরীক্ষায় টিকে গেল, আর তাদের ভালোবাসা হয়ে রইল এক অনন্ত অধ্যায়।
লেখক : উজ্জ্বল হোসাইন, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার, মোবাইল : 01675127483, ই-মেইল : rtrujjal@gmail.com
আপনার মতামত লিখুন