খুঁজুন
                               
বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫, ১৩ কার্তিক, ১৪৩২

বাংলা সাহিত্যে গল্প যখন জীবনের প্রতিচ্ছবি

উজ্জ্বল হোসাইন
প্রকাশিত: সোমবার, ৩ মার্চ, ২০২৫, ৯:৪০ পূর্বাহ্ণ
বাংলা সাহিত্যে গল্প যখন জীবনের প্রতিচ্ছবি

সাহিত্য মানেই জীবন, আর গল্প সেই জীবনের প্রতিচ্ছবি। গল্প আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, অনুভূতি, স্বপ্ন এবং সংগ্রামের কথা বলে। বাস্তবতার আয়নায় যখন গল্পের চরিত্রগুলো ফুটে ওঠে, তখন আমরা নিজের জীবনের ছায়া দেখতে পাই। কখনো সেই গল্প আনন্দ দেয়, কখনো কাঁদায়, কখনো প্রশ্ন জাগায়, আবার কখনো আশার আলো দেখায়। গল্প শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা মানুষের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। বাস্তব জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, সম্পর্কের জটিলতা, সমাজের বৈষম্য, সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম—সবকিছুই গল্পের মধ্য দিয়ে উঠে আসে। গল্প শুধু কাল্পনিক নয়, এটি জীবনের এমন এক আয়না, যা আমাদের ভাবতে শেখায়, উপলব্ধি করতে সাহায্য করে এবং কখনো কখনো আমাদের জীবনের সিদ্ধান্ত গ্রহণেও প্রভাব ফেলে।
গল্পকে অনেকেই কল্পনার সৃষ্টি মনে করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, গল্প কল্পনার মিশ্রণে বাস্তব জীবনের প্রতিফলন। প্রতিটি গল্পের পেছনে থাকে বাস্তবতার একটি নির্দিষ্ট ভিত্তি। গল্পকার তাঁর অভিজ্ঞতা, চারপাশের সমাজ বা অন্যের জীবনের কাহিনিকে নির্দিষ্ট রূপ দিয়ে গল্পের আকার দেন। যেমন-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পদ্মানদীর মাঝি” উপন্যাসটি কেবল একটি কল্পকাহিনি নয়, এটি তখনকার সমাজের দরিদ্র জেলেদের জীবনযুদ্ধের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালী”-তে আমরা অপু-দুর্গার জীবনসংগ্রামের মাধ্যমে গ্রামবাংলার বাস্তব চিত্র পাই। এই গল্পগুলো কেবল কল্পনার ফসল নয়, বরং বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া কাহিনিগুলো কল্পনার রঙে রাঙানো হয়েছে মাত্র। কিছু গল্প আবার আমাদের ভবিষ্যতের প্রতিচিত্র আঁকে, যা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য হিসেবে পরিচিত। সত্যজিৎ রায়ের “প্রফেসর শঙ্কু” বা জুল ভার্নের under the sea গল্পগুলো ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার এক চেষ্টা ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই এই কল্পনা পরে বাস্তবে পরিণত হয়েছে। গল্পে বাস্তবতা ও কল্পনার সংমিশ্রণ একটি আকর্ষণীয় শৈলী, যা পাঠকদের নতুন অভিজ্ঞতা দেয়। এ ধরনের গল্পে লেখক বাস্তব জীবনের সত্য ঘটনা, চরিত্র বা সামাজিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে কল্পনার মিশেল ঘটিয়ে একটি অনন্য জগত সৃষ্টি করেন। গল্পের স্থান, কাল ও পাত্র বাস্তব জীবনের হতে পারে, যাতে পাঠক তা বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন। কিছু অতিপ্রাকৃত, অসম্ভব বা কাল্পনিক উপাদান সংযোজন করা হয়, যা গল্পকে আকর্ষণীয় করে তোলে। বাস্তব ঘটনার সঙ্গে কল্পনার সংমিশ্রণ সমাজের বিভিন্ন দিক ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে। চরিত্ররা বাস্তব জীবনের মতোই হতে পারে, তবে তাদের কিছু বিশেষ ক্ষমতা বা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। যেমন-গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের One Hundred Years of Solitude-যেখানে বাস্তবিক ঐতিহাসিক ঘটনা এবং জাদুবাস্তবতার মিশেল রয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের “গুপী গাইন বাঘা বাইন”-যেখানে সাধারণ চরিত্রদের হাতে জাদুকরি ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়। হুমায়ূন আহমেদের অনেক উপন্যাস-যেখানে বাস্তব জীবনের গল্পের মধ্যেও রহস্যময় বা অলৌকিক ঘটনা ঘটে। এই শৈলী গল্পকে একই সঙ্গে বাস্তবসম্মত ও রোমাঞ্চকর করে তোলে, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে রাখতে পারে।
গল্প শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। একটি ভালো গল্প মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনতে পারে, সামাজিক অসঙ্গতি তুলে ধরতে পারে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। যুগে যুগে সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র সমাজ পরিবর্তনের বড় ভূমিকা রেখেছে। গল্পের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের উপায়। গল্প সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলে, যা মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “দেবদাস” উপন্যাসে সামাজিক কুসংস্কার ও নারীর দুর্দশার কথা উঠে এসেছে, যা পরবর্তী সময়ে সামাজিক পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা দিয়েছে। গল্পের চরিত্ররা অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে, যা বাস্তব জীবনের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। মার্ক টোয়েনের “অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন” দাসপ্রথার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। গল্প মানুষের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে পারে। “মা” (ম্যাক্সিম গোর্কি) উপন্যাসটি রাশিয়ার বিপ্লবের পটভূমিতে রচিত, যা বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। গল্প সমাজের ভুল ধ্যানধারণা ভাঙতে সাহায্য করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “গোরা” উপন্যাস হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছে, যা সামাজিক ঐক্য গঠনে ভূমিকা রেখেছে। গল্প শিশুরা যেমন নৈতিক শিক্ষা পায়, তেমনি প্রাপ্তবয়স্করাও জীবনের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করে। হুমায়ূন আহমেদের গল্পগুলো বাস্তব জীবনের জটিলতা সহজভাবে বুঝিয়ে দেয়, যা পাঠকদের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আনে। গল্প শুধু বিনোদনের জন্য নয়, এটি সমাজ পরিবর্তনের শক্তিশালী মাধ্যম। একটি গল্প মানুষের মনোভাব বদলাতে পারে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস জোগাতে পারে এবং সামগ্রিকভাবে সমাজকে এগিয়ে নিতে পারে। তাই, গল্পকারদের দায়িত্বশীলভাবে গল্প বলা উচিত, যাতে তা সমাজের কল্যাণে অবদান রাখতে পারে। গল্প কেবল বিনোদনের জন্য লেখা হয় না, এটি সমাজ পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমও। অনেক সময় সমাজের অসংগতি, বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গল্পকারেরা গল্পের আশ্রয় নেন। উদাহরণস্বরূপ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “দেবদাস” কেবল প্রেমের কাহিনি নয়, এটি তৎকালীন সমাজে নারীদের অবস্থা ও সামাজিক বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে এক গভীর বার্তা বহন করে। একইভাবে, রবি ঠাকুরের “গোরা” গল্পে জাতিভেদপ্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ফুটে উঠেছে। প্রতিবাদী সাহিত্য যেমন ছিল, তেমনি গল্পের মাধ্যমে অনুপ্রেরণাও দেওয়া হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “আনন্দমঠ” উপন্যাসটি ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বর্তমানে, গল্পের মাধ্যমে দারিদ্র্য, লিঙ্গবৈষম্য, পরিবেশ বিপর্যয়, প্রযুক্তির অপব্যবহার, যুদ্ধ, অভিবাসন সমস্যার মতো বিষয়গুলোও উঠে আসছে। গল্প মানুষের মনকে নাড়া দেয়, পরিবর্তনের চিন্তা জাগায় এবং সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করে।
গল্প শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি জীবনের প্রতিফলনও। গল্পের চরিত্রগুলো আমাদের চারপাশের মানুষের প্রতিচ্ছবি বহন করে। তাদের সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম, প্রেম, হতাশা—সবকিছুই বাস্তব জীবনের অনুভূতির প্রতিফলন। একটি ভালো গল্প বাস্তবতার সঙ্গে এতটাই মিশে যায় যে পাঠক তার সঙ্গে সংযোগ অনুভব করে, কখনো নিজের জীবনকে চরিত্রের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে, কখনো নতুন কিছু শেখে। গল্পকারেরা চরিত্র তৈরির সময় বাস্তব জীবনের মানুষদের পর্যবেক্ষণ করেন। যেমন, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “শ্রীকান্ত” উপন্যাসের শ্রীকান্ত চরিত্রটি অনেক বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন। আবার, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের হিমু বা মিসির আলি চরিত্রগুলো সমাজের নানা দিককে তুলে ধরে। গল্পের চরিত্রগুলো মানুষের হাসি-কান্না, ভালোবাসা-বেদনা, সংগ্রাম-সফলতার প্রতিচিত্র। প্রেমের উপন্যাসে যেমন চরিত্ররা ভালোবাসার গভীর অনুভূতি প্রকাশ করে, তেমনি যুদ্ধ বা বিপ্লবমূলক গল্পে তারা লড়াই ও আত্মত্যাগের চিত্র ফুটিয়ে তোলে। গল্পের চরিত্ররা তাদের সময় ও সমাজের প্রতিফলন বহন করে। যেমন, মার্ক্সিম গোর্কির “মা” উপন্যাসের নায়িকা একজন সাধারণ রুশ শ্রমজীবী নারী, যিনি ধীরে ধীরে বিপ্লবের অংশ হয়ে ওঠেন। আবার, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালী”-এর অপু চরিত্রটি দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনসংগ্রামের বাস্তব প্রতিচিত্র। মহাভারতের যুধিষ্ঠির চরিত্র সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অটল থাকার শিক্ষা দেয়, আবার শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ চরিত্র ক্ষমতার লোভের কুফল দেখায়। কোনো চরিত্রের জীবনসংগ্রাম, প্রেম বা আত্মত্যাগ পাঠককে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সামাজিক অবিচার বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে গল্পের চরিত্ররা লড়াই করে, যা পাঠকদের সচেতন করে তোলে। অনেক চরিত্র মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে, যেমন হ্যারি পটারের সাহসিকতা বা রবীন্দ্রনাথের “গোরা”-র আত্ম-অনুসন্ধান।
গল্পের চরিত্র শুধু কল্পনার সৃষ্টি নয়; তারা জীবনেরই অংশ। বাস্তব জীবনের ঘটনা ও অনুভূতিগুলো গল্পে এসে মিশে যায়, যা পাঠকের মনকে নাড়া দেয়, সমাজকে সচেতন করে এবং জীবনের গভীর সত্যকে তুলে ধরে। তাই, গল্পের চরিত্রগুলো আমাদের চারপাশের বাস্তবতারই এক বিশেষ প্রতিফলন। গল্পের চরিত্র ও জীবনের প্রতিফলন গল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর চরিত্রগুলো। মানুষ জীবনে নানা সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যায়—পিতা-মাতা, ভাই-বোন, বন্ধু, প্রেমিক-প্রেমিকা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী—প্রত্যেকেরই আলাদা গল্প আছে। গল্পের চরিত্রগুলো সেই বাস্তব জীবনেরই প্রতিচিত্র। উদাহরণ হিসেবে, প্রেমচাঁদের “গবন” উপন্যাসের চরিত্ররা মধ্যবিত্ত সমাজের লোভ, লাঞ্ছনা ও সংগ্রামের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। “নসিবন”, “হিরামন”, “সোহিনী”-রা বাস্তব জীবনেরই চরিত্র, যারা আমাদের আশেপাশে দেখা যায়। শরৎচন্দ্রের গল্পে গ্রামের সাধারণ মেয়ে রাজলক্ষ্মী বা অভিজাত পরিবারের দেবদাস, বঙ্কিমের উপন্যাসে দুর্ধর্ষ স্বাধীনতাকামী নারীরা প্রত্যেকটি চরিত্র বাস্তব জীবনেরই ছায়া। পাঠক এই চরিত্রগুলোর মধ্যে নিজেদের খুঁজে পান।
গল্প মানুষের হৃদয়ের ভাষা। এতে সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বিষাদ, প্রেম, বিরহসহ জীবনের নানা অনুভূতি মূর্ত হয়ে ওঠে। আবেগ হলো গল্পের প্রাণ, যা পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। আনন্দ ও বিরহ এই দুটি আবেগ গল্পের অন্যতম শক্তিশালী উপাদান। কিছু গল্প হাসায়, আনন্দ দেয়, আবার কিছু গল্প কাঁদায়, ব্যথিত করে। জীবনের মতোই গল্পেও এই দুই বিপরীত অনুভূতির অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। আনন্দ ও বিরহ কেবল গল্পের সৌন্দর্য বাড়ায় না, বরং চরিত্র ও কাহিনির গভীরতা বাড়িয়ে পাঠকের মনে গভীর রেখাপাত করে। গল্পের প্রধান কাজ হলো পাঠকের মনকে স্পর্শ করা। এজন্য গল্পে আবেগের উপস্থিতি অপরিহার্য। আবেগহীন গল্প প্রাণহীন হয়ে যায়। আনন্দ ও বিরহের সংমিশ্রণ গল্পকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। গল্পের আবেগ পাঠকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিল খুঁজে পেতে সাহায্য করে। কেউ যখন আনন্দময় গল্প পড়ে, তখন তার নিজের জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো মনে পড়ে যায়। তেমনই, বিরহের গল্প পাঠকের মনে দুঃখের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। আবেগের কারণে গল্পের চরিত্রগুলো বাস্তব মনে হয়। তাদের হাসি-কান্না, ভালোবাসা, বেদনা পাঠকের মনে গভীর ছাপ ফেলে। শুধুমাত্র ঘটনা দিয়ে গল্প হয় না; আবেগ গল্পকে প্রাণবন্ত করে তোলে। আনন্দময় গল্প পাঠককে হাসায়, স্বস্তি দেয়, আর বিরহের গল্প পাঠককে দুঃখের গভীরে নিয়ে যায়।
আনন্দ মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ। গল্পেও এই আনন্দের প্রকাশ ভিন্ন ভিন্নভাবে ঘটে। হাস্যরস এমন একটি উপাদান, যা পাঠকের মনকে আনন্দিত করে। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলী, পরশুরাম, সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্পে চমৎকার রসবোধ রয়েছে। এসব গল্পে আনন্দ পাঠকের ক্লান্ত মনকে চাঙ্গা করে তোলে। টেনিদা সিরিজ (নরেন্দ্রনাথ মিত্র)-যেখানে চরিত্রদের কৌতুকপূর্ণ সংলাপ পাঠককে হাসতে বাধ্য করে। গোগোল (সত্যজিৎ রায়) রহস্যময় গল্প হলেও অনেক মজার সংলাপ ও পরিস্থিতি পাঠককে আনন্দ দেয়। প্রেম সবসময় দুঃখের হয় না, কিছু প্রেমের গল্প পাঠকের মনে আনন্দের অনুভূতি সৃষ্টি করে। প্রেম যখন সফল হয়, তখন তা গল্পে সুখের আবেশ এনে দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ল্যাবরেটরি”-প্রেমের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা একটি গল্প, যেখানে নারী চরিত্রের শক্তিশালী উপস্থিতি গল্পের আনন্দের মাত্রা বাড়ায়। হুমায়ূন আহমেদের “হিমু” সিরিজ যেখানে হিমুর উদ্ভট জীবনযাপন ও সংলাপ পাঠককে আনন্দ দেয়। পরিবার ও বন্ধুত্ব নিয়ে লেখা অনেক গল্প রয়েছে, যা পাঠকের মনে উষ্ণতা ও আনন্দ আনে। সত্যজিৎ রায়ের “গুপী গাইন বাঘা বাইন” দুই বন্ধুর সঙ্গীত ও দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালী” অপু ও দুর্গার শৈশবের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো গল্পে এক অনন্য আনন্দের আবহ সৃষ্টি করে। বিরহ মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভালোবাসা যেমন জীবনে সুখ এনে দেয়, তেমনি বিচ্ছেদ আনে দুঃখ ও বেদনা। গল্পেও বিরহের গভীর ছোঁয়া পাওয়া যায়, যা পাঠককে আবেগপ্রবণ করে তোলে। প্রেমের গল্পে বিরহ সবসময় একটি শক্তিশালী উপাদান। বিচ্ছেদ, অপূর্ণতা, ভুল বোঝাবুঝি এসব বিষয় প্রেমের গল্পে বিরহের আবহ তৈরি করে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “দেবদাস” – প্রেমের কষ্ট ও বিচ্ছেদ কীভাবে একজন মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যেতে পারে, তা চিত্রিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “শেষের কবিতা” যেখানে অমিত ও লাবণ্যের প্রেম পরিণতি পায় না, কিন্তু তাতে এক অনন্য বেদনার সৌন্দর্য রয়ে যায়। গল্পে কখনো সমাজের কারণে মানুষের জীবনে বিরহ আসে। সামাজিক নিয়ম, কুসংস্কার, দারিদ্র্য এসবের ফলে অনেক চরিত্রের জীবন দুঃখময় হয়ে ওঠে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “আরণ্যক” যেখানে শহর ছেড়ে অরণ্যের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিলেও, শেষ পর্যন্ত সেই অরণ্য থেকে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা রয়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পদ্মানদীর মাঝি” যেখানে কুবের চরিত্রটি দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবনের প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করে। যুদ্ধের গল্পে বিচ্ছেদ, মৃত্যু ও হারানোর ব্যথা গভীরভাবে ফুটে ওঠে। এরিচ মারিয়া রেমার্কের “অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট” যেখানে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও বন্ধুদের হারানোর বেদনা বিরহের আবহ তৈরি করে।সেলিনা হোসেনের “হাঙর নদী গ্রেনেড” মুক্তিযুদ্ধের কষ্ট, হারানোর বেদনা এবং দেশপ্রেমের বিরহ এই উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে।
গল্পে কখনো কখনো আনন্দ ও বিরহ পাশাপাশি থাকে। জীবনের মতোই গল্পেও হাসি-কান্না একসঙ্গে মিশে যায়। হুমায়ূন আহমেদের “কোথাও কেউ নেই” – বাকের ভাইয়ের চরিত্রটি প্রথমে আনন্দ দেয়, কিন্তু গল্পের শেষ পরিণতি পাঠককে কাঁদিয়ে তোলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কাবুলিওয়ালা” – প্রথমে মিনি ও কাবুলিওয়ালার সম্পর্ক আনন্দ দেয়, কিন্তু কাবুলিওয়ালার বিদায়ের দৃশ্য পাঠকের মনে গভীর দুঃখ সৃষ্টি করে। আনন্দ ও বিরহ গল্পের দুই অপরিহার্য অংশ। জীবনের মতো গল্পেও সুখ ও দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলে। কখনো হাসায়, কখনো কাঁদায়। আনন্দময় গল্প পাঠককে স্বস্তি দেয়, আর বিরহের গল্প পাঠককে ভাবিয়ে তোলে, গভীর আবেগে আপ্লুত করে। ভালো গল্পের সৌন্দর্য এটাই—যেখানে আনন্দ ও বিরহ একসঙ্গে মিলেমিশে পাঠকের মনে স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। গল্প আবেগকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। সুখ, দুঃখ, প্রেম, বিরহ, আনন্দ—সবকিছু গল্পের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “শেষের কবিতা” প্রেমের এক অনন্য উদাহরণ, যেখানে লাবণ্য ও অমিতের সম্পর্কের টানাপোড়েন জীবনের বাস্তবতার প্রতিচিত্র। একইভাবে, বিভূতিভূষণের “আরণ্যক” আমাদের প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সংযোগের গল্প বলে। কিছু গল্প কেবল আনন্দ দেয়, কিছু গল্প আবার কাঁদায়। বিভূতিভূষণের “পথের পাঁচালী”-তে দুর্গার মৃত্যু পাঠকের চোখে জল এনে দেয়, আবার “অপরাজিত”-তে অপু যখন নতুন জীবনের পথে এগিয়ে যায়, তখন পাঠকের মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়। প্রতিটি যুগে গল্পের ধরণ পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীনকালে গল্প ছিল পৌরাণিক, যেমন “মহাভারত”, “রামায়ণ”, “থাকুরমার ঝুলি”। উনিশ শতকে গল্পের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের প্রচেষ্টা দেখা যায়, যেমন বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য। বিশ শতকে মানুষের মানসিক দ্বন্দ্ব, বিশ্বযুদ্ধ, রাজনৈতিক পরিবর্তন—এসব গল্পের মধ্যে উঠে এসেছে। একবিংশ শতকে প্রযুক্তি, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, নারীবাদ, রাজনৈতিক মতাদর্শ, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি গল্পের মূল বিষয় হয়ে উঠছে।
গল্প শুধু কিছু শব্দের বিন্যাস নয়, এটি জীবনের প্রতিচ্ছবি। গল্প আমাদের বাস্তবতার দর্পণ, যা আমাদের জীবন ও সমাজকে নতুনভাবে দেখতে শেখায়। কখনো গল্প আমাদের ভাবায়, কখনো স্বপ্ন দেখায়, কখনো প্রতিবাদী করে তোলে, আবার কখনো আনন্দ দেয়। সাহিত্যের এই শক্তিশালী মাধ্যম আমাদের অতীতের সঙ্গে পরিচয় করায়, বর্তমানকে বোঝায় এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। গল্প শুধু কল্পনার খেলা নয়, এটি বাস্তবতার এক রঙিন ছোঁয়া, যা আমাদের চিন্তাভাবনার গভীরে প্রবেশ করে এবং আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে। গল্প জীবনকে শেখায়, জীবন গল্পকে বাঁচিয়ে রাখে।
লেখক পরিচিতি : উজ্জ্বল হোসাইন, লেখক ও প্রাবন্ধিক, চাঁদপুর।

সংবাদ : সাংবাদিকতার অর্থনীতি, রাজনৈতিক চাপ ও নৈতিক দ্বন্দ্ব

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত: বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫, ১:৪৮ অপরাহ্ণ
সংবাদ : সাংবাদিকতার অর্থনীতি, রাজনৈতিক চাপ ও নৈতিক দ্বন্দ্ব

বর্তমান বিশ্বে সাংবাদিকতা এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। গণমাধ্যম এখন আর শুধু তথ্য প্রচারের মাধ্যম নয়, বরং অর্থনৈতিক চাপ, রাজনৈতিক প্রভাব এবং নৈতিক সংকটের জটিল সমীকরণের ভেতরে বন্দী।
অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম বিজ্ঞাপননির্ভর হওয়ায় তাদের স্বাধীনতা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। সরকারি ও কর্পোরেট বিজ্ঞাপনই অনেক প্রতিষ্ঠানের আয়ের মূল উৎস। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের বিপরীতে প্রতিবেদন প্রকাশে সাংবাদিকরা প্রায়ই বাধার সম্মুখীন হন। ডিজিটাল যুগে ইউটিউব ও ফেসবুকের মতো প্ল্যাটফর্ম বিজ্ঞাপন আয়ের বড় অংশ নিয়ে নেওয়ায় সংবাদমাধ্যমগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
রাজনৈতিক চাপও সাংবাদিকতার অন্যতম বড় বাধা। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় সংবাদ নিয়ন্ত্রণে প্রভাব বিস্তার করে, সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশে বাধা দেয়। মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকরা প্রায়ই হয়রানি, মামলা ও হামলার শিকার হন। এতে সংবাদমাধ্যমের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
এছাড়া নৈতিক দ্বন্দ্বও আজ সাংবাদিকতার মূল সমস্যা। ভিউ বা ক্লিক বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় অনেক সময় সত্যের চেয়ে আকর্ষণীয় শিরোনামকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। এতে পেশাগত সততা ও জনআস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সত্য ও মানবতার পক্ষে সাংবাদিকতার নৈতিক ভিত্তি পুনর্গঠন এখন সময়ের দাবি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক সহনশীলতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে সাংবাদিকতা আবারও হতে পারে সমাজের আয়না ও রাষ্ট্রের প্রকৃত চতুর্থ স্তম্ভ।
সাংবাদিকতা একটি জাতির বিবেক, সমাজের দর্পণ এবং রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে সাংবাদিকতা আর কেবল তথ্য প্রচারের মাধ্যম নয়; এটি আজ অর্থনীতি, রাজনীতি এবং নৈতিকতার জটিল সম্পর্কের ভেতর আটকে পড়া একটি প্রতিষ্ঠান। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা যেখানে গণতন্ত্রের মূল শর্ত, সেখানে অর্থনৈতিক স্বার্থ, রাজনৈতিক চাপ এবং নৈতিক দ্বন্দ্ব এই স্বাধীনতাকে প্রতিনিয়ত সংকুচিত করে চলেছে।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল এই শিল্প অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও কর্পোরেট চাপ সাংবাদিকদের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ফলে সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য—সত্য প্রকাশ—প্রায়ই বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর কাছে বন্দী হয়ে পড়ছে।
সাংবাদিকতার অর্থনীতি ও স্বাধীনতার শর্ত :
একটি সংবাদমাধ্যম পরিচালনা করতে যেমন সাংবাদিকতার আদর্শ প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। সাংবাদিকতার অর্থনীতি মূলত তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে—বিজ্ঞাপন, পাঠক বা দর্শক নির্ভর আয়, এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ।
১. বিজ্ঞাপন নির্ভরতা ও তার প্রভাব : বেশিরভাগ প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রধান আয় আসে বিজ্ঞাপন থেকে। সরকারি ও কর্পোরেট বিজ্ঞাপনই অনেক পত্রিকার বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা। ফলে সংবাদপত্রগুলো প্রায়ই বিজ্ঞাপনদাতাদের স্বার্থের বিপরীতে যেতে পারে না।
একটি বড় কোম্পানির অনৈতিক কার্যক্রম বা পরিবেশ দূষণ নিয়ে অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন অনেক সময় চাপের মুখে বাতিল হয়ে যায়, কারণ সেই কোম্পানি পত্রিকাটির অন্যতম বিজ্ঞাপনদাতা।
২. ডিজিটাল যুগের অর্থনৈতিক রূপান্তর : অনলাইন সাংবাদিকতার যুগে বিজ্ঞাপন আয় আরও বিভক্ত হয়েছে। ইউটিউব, ফেসবুক, গুগলের মতো টেক জায়ান্টরা এখন বিজ্ঞাপন আয়ের বড় অংশ নিজেদের দখলে রেখেছে। ফলে সংবাদমাধ্যমগুলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যেখানে অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে কোন সংবাদ বেশি প্রচার পাবে। এর ফলে গঠনমূলক সাংবাদিকতার চেয়ে ‘ক্লিকবেট’ সংবাদ, উত্তেজক শিরোনাম ও ভিউ নির্ভর কনটেন্ট বাড়ছে।
৩. সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা : অর্থনৈতিক দুরবস্থার ফলে অনেক সংবাদকর্মী ন্যায্য বেতন পান না, কিংবা নিয়মিত বেতন পেতেও সমস্যার সম্মুখীন হন। চাকরির অনিশ্চয়তা, প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক, এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষার অভাব সাংবাদিকদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। ফলস্বরূপ তারা পেশাগত স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেন, এবং কখনও কখনও আত্মরক্ষার তাগিদে আপোষে বাধ্য হন।
রাজনৈতিক চাপ ও স্বাধীন সাংবাদিকতার শত্রু : বাংলাদেশসহ বহু দেশে রাজনৈতিক প্রভাব সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমের কাজ হলো ক্ষমতার জবাবদিহি নিশ্চিত করা, কিন্তু রাজনৈতিক দল ও শাসকগোষ্ঠী সেই স্বাধীনতাকে নিজের সুবিধামতো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
১. সরকারি প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ : সরকার প্রায়ই বিজ্ঞাপন, নিবন্ধন, ফ্রিকোয়েন্সি বা লাইসেন্স ইস্যুর মাধ্যমে গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। যেসব পত্রিকা বা টেলিভিশন সরকারবিরোধী সংবাদ প্রকাশ করে, তাদের ওপর বিভিন্ন প্রশাসনিক বা আর্থিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। কখনও কখনও ‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড’ বা ‘ভুয়া তথ্য প্রচার’-এর অভিযোগ তুলে মামলা করা হয়, যা সাংবাদিকদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।
২. রাজনৈতিক দলীয় বিভাজন : রাজনৈতিক বিভাজন সাংবাদিকতার ভেতরও ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক সংবাদমাধ্যম সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের অনুগত হয়ে কাজ করছে। এতে সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতা নষ্ট হচ্ছে, আর পাঠকের আস্থা কমছে। ‘একপক্ষীয় সাংবাদিকতা’ সাধারণ মানুষের চোখে মিডিয়াকে পক্ষপাতদুষ্ট ও অবিশ্বাস্য করে তুলছে।
৩. মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক সহিংসতা : জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকরা প্রায়ই রাজনৈতিক নেতাদের হুমকি ও হামলার শিকার হন। তাদের ওপর মামলা, লাঞ্ছনা, কিংবা পেশাগত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ‘কথা না শোনার’ কারণে সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে পড়েন।
নৈতিক দ্বন্দ্ব ও সাংবাদিকতার আত্মার পরীক্ষা : সাংবাদিকতা কেবল পেশা নয়, এটি একধরনের নৈতিক দায়িত্ব। সত্য অনুসন্ধান ও সমাজের কল্যাণের জন্য সাংবাদিকের মননে থাকা চাই সততা, মানবিকতা ও সাহস। কিন্তু বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক যুগে এই নৈতিক মানদণ্ডকে রক্ষা করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।
১. সত্য বনাম জনপ্রিয়তা : ডিজিটাল যুগে ক্লিক, ভিউ ও লাইকই হয়ে উঠেছে সংবাদমূল্যের মাপকাঠি। ফলে অনেক সাংবাদিক সত্যের চেয়ে ‘ট্রেন্ডিং’ বিষয়কে প্রাধান্য দেন। সংবাদে অতিরঞ্জন, ভুয়া তথ্য, এমনকি গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করে ‘সেন্সেশন’ তৈরি করা এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এটি সাংবাদিকতার নৈতিক ভিত্তিকে ক্ষয় করছে।
২. গোপন স্বার্থ ও প্রলোভন : কখনও রাজনৈতিক সুবিধা, কখনও আর্থিক প্রলোভন সাংবাদিকদের নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত করে। কোনো কোনো সাংবাদিক নির্দিষ্ট ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের প্রচারণায় জড়িয়ে পড়েন। এর ফলে পেশাদার ন্যায়বোধ দুর্বল হয়, সংবাদপত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়।
৩. ব্যক্তিগত ঝুঁকি ও ভয় : সত্য প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের অনেক সময় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে হয়। অনেক সাংবাদিক হুমকি, অপহরণ কিংবা হত্যার শিকার হয়েছেন। এই ভয় অনেককে আত্মনিয়ন্ত্রণে বাধ্য করে যা নৈতিক দ্বন্দ্বকে আরও গভীর করে তোলে।
সামাজিক মাধ্যমে নতুন যুগের নতুন চ্যালেঞ্জ : সামাজিক মাধ্যম আজ সংবাদ প্রচারের নতুন প্ল্যাটফর্ম, কিন্তু এটি সাংবাদিকতার নীতি ও পেশাদারিত্বের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জও বটে। যেকোনো ব্যক্তি এখন সংবাদ প্রচার করতে পারে, কিন্তু যাচাই-বাছাই ছাড়া তথ্য ছড়ানো সহজ হয়ে যাওয়ায় মিথ্যা সংবাদ ও বিভ্রান্তি বাড়ছে।
‘সিটিজেন জার্নালিজম’-এর ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে—ঘটনার দ্রুত প্রচার, তেমনি এর অপব্যবহারও ব্যাপক। অনেক ক্ষেত্রেই ফেসবুক বা ইউটিউবে ভাইরাল হওয়া সংবাদই পরে ভুয়া প্রমাণিত হয়, কিন্তু ততক্ষণে সেটি জনমত প্রভাবিত করে ফেলে। পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য এটি এক কঠিন প্রতিযোগিতা—যেখানে গতি ও জনপ্রিয়তা সত্য ও দায়িত্বের চেয়ে বেশি মূল্য পায়।

নৈতিক সাংবাদিকতার প্রয়োজনীয়তা : সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সাংবাদিকতার একটি স্পষ্ট নৈতিক কাঠামো থাকা জরুরি। বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের আচরণবিধি, আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠনগুলোর কোড অব কন্ডাক্ট—এসব কেবল কাগজে নয়, বাস্তবে প্রয়োগ করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।
সাংবাদিকদের উচিত :  তথ্য যাচাই না করে কিছুই প্রকাশ না করা। ব্যক্তিগত বা দলীয় পক্ষপাত এড়িয়ে নিরপেক্ষ থাকা। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির মতামত অন্তর্ভুক্ত করা। সমাজে শান্তি ও মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা করা। একই সঙ্গে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোরও প্রয়োজন পেশাদার প্রশিক্ষণ, ন্যায্য বেতন এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ : সাংবাদিকতার টিকে থাকার জন্য দরকার মুক্ত চিন্তা, নিরাপদ পরিবেশ ও অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব। সরকারকে বুঝতে হবে—স্বাধীন সাংবাদিকতা কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজ নয়, বরং তা রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে।
সত্যের পক্ষে কলমই এখন সবচেয়ে বড় শক্তি। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন বা সাইবার আইনের মতো বিধান সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে নয়, বরং ভুয়া সংবাদ ও ঘৃণা প্রচার রোধে ব্যবহার করা উচিত। একই সঙ্গে গণমাধ্যমকে নিজস্ব ‘অভ্যন্তরীণ সেন্সরশিপ’ সংস্কৃতি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।
সাংবাদিকতার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো সমাজে সত্য, ন্যায় ও মানবতার আলো ছড়ানো। কিন্তু এই পথে রয়েছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং নৈতিক দ্বন্দ্বের পাহাড়। তবুও সাহসী ও নৈতিক সাংবাদিকরাই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন—যারা আপোষহীনভাবে সত্যের পক্ষে দাঁড়ান। আজকের সাংবাদিকতার সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—সে কি টিকে থাকবে স্বাধীন ও সৎভাবে, নাকি অর্থ ও ক্ষমতার দাসত্বে পরিণত হবে? এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে সাংবাদিকদের সততা, সমাজের সচেতনতা, এবং রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মনোভাবের ওপর। সত্য প্রকাশের এই কঠিন যাত্রায় সাংবাদিকদের হাতে এখনো সেই কলম রয়েছে—যা বন্দুকের চেয়েও শক্তিশালী। এই শক্তিকে বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের সকলের দায়িত্ব।
সাংবাদিকতার অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক প্রভাব এবং নৈতিক দুরবস্থা—এই তিনটি চ্যালেঞ্জ একসঙ্গে সাংবাদিকতার অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী—যে জাতির কলম বেঁচে থাকে, তার বিবেক কখনো মরে না। আজও অনেক সাংবাদিক অন্ধকার ভেদ করে সত্যের আলো জ্বালাচ্ছেন। তাদের সংগ্রামই প্রমাণ করে, সাংবাদিকতা কেবল একটি পেশা নয়—এটি এক মহৎ প্রতিশ্রুতি, মানবতার প্রতি অঙ্গীকার।

লেখক : উজ্জ্বল হোসাইন, সাংবাদিক ও লেখক, চাঁদপুর।
সত্যের পক্ষে সেই কলমকে বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের সকলের দায়িত্ব, কারণ সত্য প্রকাশের শক্তি সব সময়ই বন্দুকের চেয়ে বড়।

সালমান শাহ হত্যা মামলা : আগাম জামিন চাইবেন সামিরা, হাইকোর্টে বর্তমান স্বামী

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত: বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫, ১২:০১ অপরাহ্ণ
সালমান শাহ হত্যা মামলা : আগাম জামিন চাইবেন সামিরা, হাইকোর্টে বর্তমান স্বামী

চিত্রনায়ক সালমান শাহকে হত্যা মামলার প্রধান আসামি সামিরা হক আজ হাইকোর্টে আগাম জামিন চাইবেন। মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) তার বর্তমান স্বামী হাইকোর্টে আসেন জামিন শুনানির জন্য আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে। এদিন সকাল ৯ টায় সামিরার বর্তমান স্বামী  ইশতিয়াক আহমেদকে আপিল বিভাগে বসে থাকতে দেখা যায়। এসময় বেশ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এর আগে সালমান শাহ এর সাবেক স্ত্রী এবং খলনায়ক আশরাফুল হক ডনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের শুনানিতে গতকাল সোমবার (২৭ অক্টোবর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট  সাইফুজ্জামান এ আদেশ দেন।
গত ২০ অক্টোবর মধ্যরাতে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরীর পক্ষে তার ভাই মোহাম্মদ আলমগীর কুমকুম মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা হলেন- সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক, শাশুড়ি লতিফা হক লুছি, বিতর্কিত ব্যবসায়ী অলিম্পিক ইন্ড্রাস্ট্রিজের মালিক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বাংলা চলচ্চিত্রের খলনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল হক ওরফে ডন। ডেভিড, জাভেদ ও ফারুক নামের তিন জনকে আসামি করা হয়েছে, যাদের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে রাজধানীর বিএফডিসি। এছাড়া আরও চারজনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- ফরিদপুরের রেজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, রুবী, আ. ছাত্তার ও সাজু। মামলা পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১৩ অক্টোবর আদালতে শুনানির সময় এ প্রথম উপস্থিত ছিলেন সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা হক। এর এক সপ্তাহ পরই আদালতের নির্দেশে রাজধানীর রমনা থানায় হত্যা মামলাটি করা হয়। এর পরেই তিনি গা ঢাকা দেন বলে জানা যায়। তবে আজ তার বর্তমান স্বামী আদালতে উপস্থিত হয়েছেন তার জামিন বিষয়ে কথা বলতে।

মেট্রোরেল দুর্ঘটনা : বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ৩০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ হাইকোর্টের

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত: বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫, ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ
মেট্রোরেল দুর্ঘটনা : বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ৩০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার নির্দেশ হাইকোর্টের

মেট্রোরেলের সার্বিক নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ৩০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বুধবার (২৯ অক্টোবর) মেট্টোরেল ও সব ফ্লাইওভারের বিয়ারিং প্যাডের গুণগত মান নির্ণয়ে কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
গত সোমবার মেট্রোরেল ও সব ফ্লাইওভারের বিয়ারিং প্যাডের গুণগত মান নির্ণয়ে কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন। রিটে মেট্রোরেল ও সব ফ্লাইওভারে ব্যবহার করা বিয়ারিং প্যাডের গুণগত মান ঠিক আছে কি না, তা যাচাই করতে একটি কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। এর আগে গত রোববার (২৬ অক্টোবর) ফার্মগেট মেট্রোরেলের নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ওপর থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে আবুল কালাম আজাদ নামে এক পথচারীর মাথায় আঘাত হানে। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। ঘটনাস্থলেই প্রচুর রক্তপাত হলে স্থানীয় লোকজন দ্রুত তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।