গণমাধ্যম সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সময়ের দাবি


গণমাধ্যম একটি সমাজের প্রতিচ্ছবি। এটি সমাজের দৃষ্টি, শ্রবণ এবং কণ্ঠস্বর। সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধি, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ রক্ষার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। তবে সময়ের পরিক্রমায় গণমাধ্যমে কিছু সমস্যাও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, যা এর প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতাকে ব্যাহত করছে। তাই গণমাধ্যম সংস্কার আজ সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমান গণমাধ্যমে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার ঘাটতি স্পষ্ট। গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক বা কর্পোরেট প্রভাবের অধীন। সংবাদ পরিবেশনে পক্ষপাতিত্ব, বিভ্রান্তিকর শিরোনাম এবং তথ্যের অপব্যবহার সমাজে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উত্থানের ফলে ভুয়া সংবাদ এবং গুজবের মাত্রা বেড়েছে। অনেক সময় সত্য-মিথ্যা যাচাই না করেই সংবাদ প্রচার করা হয়, যা সমাজে বিভ্রান্তি এবং উত্তেজনার সৃষ্টি করে। গণমাধ্যমের একটি বড় অংশ এখন বাণিজ্যিক স্বার্থে পরিচালিত। বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপে অনেক সময় মূল সংবাদকে আড়ালে রেখে মনগড়া খবর প্রকাশিত হয়। এর ফলে প্রকৃত ঘটনা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রেই সাংবাদিকদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। তাদের মতপ্রকাশে বাধা দেওয়া হয়, এবং অনেক সময় তাদের জীবন ঝুঁকির মুখেও পড়ে। এটি শুধু সাংবাদিকতার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং গণতান্ত্রিক পরিবেশের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তি যেমন সুবিধা এনে দিয়েছে, তেমনি এর অপব্যবহারও বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহার এবং প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে এর ব্যবহার গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
গণমাধ্যমের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এর সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। কিছু মৌলিক ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করা গেলে গণমাধ্যমকে সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব। গণমাধ্যমের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য স্বচ্ছ এবং কার্যকর নীতিমালা প্রয়োজন। ভুয়া সংবাদ ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন জরুরি। সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার পাশাপাশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এটি সাংবাদিকতার মান উন্নত করবে। গণমাধ্যমকর্মীদের পেশাদারিত্ব বাড়াতে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। তথ্য যাচাইয়ের পদ্ধতি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নৈতিক সাংবাদিকতার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। গণমাধ্যমকে দলীয় ও কর্পোরেট প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এটি করতে হলে স্বাধীন সম্পাদকীয় বোর্ড গঠন এবং সংবাদ পরিবেশনার সময় নীতিমালা মেনে চলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করতে হবে। ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের সাথে সমন্বয় এবং নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন।
গণমাধ্যমের সংস্কার হলে এর প্রভাব শুধু সংবাদমাধ্যমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা সমাজের সর্বস্তরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে। স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ গণমাধ্যম গণতন্ত্রের ভিত্তিকে আরও মজবুত করবে। এটি জনমতের প্রতিফলন ঘটাবে এবং জনস্বার্থে কাজ করবে। গুজব এবং ভুয়া সংবাদ কমলে সমাজে বিভেদ কমে আসবে। এর ফলে বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকবে। সংস্কারের মাধ্যমে গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরবে। সাধারণ মানুষ নির্ভরযোগ্য এবং সঠিক তথ্য পেতে সক্ষম হবে। গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা বাড়লে এটি শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। সরকার, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। গণমাধ্যমকে বলা হয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এটি নাগরিকদের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করে এবং সমাজের নীতি-নৈতিকতা ও শৃঙ্খলার রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ করে। তবে সময়ের সাথে সাথে গণমাধ্যম তার আদর্শ থেকে সরে এসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর সংস্কার একান্ত জরুরি। গণমাধ্যমের সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে সমাজের মৌলিক কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
গণমাধ্যম প্রাচীনকাল থেকেই জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করেছে। এক সময় প্রিন্ট মিডিয়া সমাজের জাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছিল। স্বাধীনতার আন্দোলনে কিংবা সামাজিক বিপ্লবে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। সময়ের পরিক্রমায় টেলিভিশন এবং পরে ডিজিটাল মিডিয়া সেই দায়িত্বকে আরও বিস্তৃত করে। গণমাধ্যম শুধু তথ্য পরিবেশনই করে না, বরং নৈতিকতা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশেও সহায়ক। এটি একদিকে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে, অন্যদিকে জনগণকে সচেতন করার কাজে নিয়োজিত থাকে। আজকের গণমাধ্যমে অনেক সময় খবরের গভীরে যাওয়ার চেয়ে সেনসেশন তৈরি করার প্রবণতা দেখা যায়। রাজনৈতিক প্রভাব কিংবা বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে অনেক সময় সংবাদকে বিকৃত করা হয়। গণমাধ্যমে মানসম্মত কনটেন্টের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রেই বিনোদনকে খবরের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশেষ করে ট্যাবলয়েড সংস্কৃতির উত্থানের ফলে প্রকৃত খবর আড়ালে চলে যাচ্ছে। গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার দাবি বহু পুরোনো। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে একপক্ষের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সত্ত্বেও অনেক সাংবাদিক তথ্য যাচাই বা ন্যূনতম পেশাদারিত্বের মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। ফলে ভ্রান্ত খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সোশ্যাল মিডিয়া গণমাধ্যমের বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটি যেমন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলেছে, তেমনি ভুয়া খবর, বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং ঘৃণামূলক বার্তা ছড়ানোর মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা এবং গবেষণার উপর জোর দিতে হবে। সাংবাদিকদের জন্য কঠোর নৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং তার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক এবং কর্পোরেট প্রভাবমুক্ত গণমাধ্যম গড়ে তোলা জরুরি। এজন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল মিডিয়ার বিকাশ গণমাধ্যমকে নতুন দিগন্তে নিয়ে গেছে। তবে এর অপব্যবহার রোধ করতে উপযুক্ত প্রযুক্তিগত সমাধান প্রয়োগ করতে হবে। গণমাধ্যমের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। এটি নিশ্চিত করতে স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যারা গণমাধ্যমের কার্যক্রমের উপর নজরদারি করবে। সাংবাদিকদের পেশাদারিত্ব উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা কর্মসূচি চালু করতে হবে। এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, যাচাই এবং উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা বাড়বে। ভুয়া খবর ছড়ানোর প্রবণতা বন্ধ করতে গণমাধ্যমকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। তথ্য যাচাইয়ের জন্য বিশেষ দল এবং প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে।
স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গণমাধ্যম সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সততা এবং নিরপেক্ষতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করলে জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়বে। সংস্কারের মাধ্যমে প্রযুক্তিকে সঠিক উপায়ে ব্যবহার করা গেলে ভুয়া খবর এবং অপপ্রচারের মতো সমস্যা দূর হবে। গণমাধ্যমের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হবে।
গণমাধ্যমের প্রকৃত শক্তি নিহিত রয়েছে তার স্বাধীনতা, সততা এবং বস্তুনিষ্ঠতার মধ্যে। সময়ের সাথে সাথে এই প্রতিষ্ঠানটি নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, যা এর গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ন করেছে। তাই এখনই সময় গণমাধ্যম সংস্কারের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে গণমাধ্যমকে তার মূল আদর্শে ফিরে যেতে হবে। একটি স্বাধীন, নৈতিক এবং আধুনিক গণমাধ্যমই কেবল একটি উন্নত এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। গণমাধ্যম একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। এটি সঠিকভাবে কাজ করতে না পারলে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমকে পুনর্গঠিত করে ন্যায়, সততা এবং স্বচ্ছতার উপর ভিত্তি করে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজন। এজন্য সমাজের প্রতিটি অংশের, বিশেষ করে নীতি-নির্ধারকদের, দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা জরুরি। গণমাধ্যম সংস্কারের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক এবং গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
লেখক পরিচিতি : উজ্জ্বল হোসাইন, বিএসসি, এলএলবি, এমসিএস, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স (২০২১), পিআইবি।
আপনার মতামত লিখুন