খুঁজুন
                               
মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫, ১২ কার্তিক, ১৪৩২

কাঙাল হরিনাথ বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

উজ্জ্বল হোসাইন
প্রকাশিত: রবিবার, ২৬ জানুয়ারি, ২০২৫, ১১:৫১ অপরাহ্ণ
কাঙাল হরিনাথ বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

কাঙাল হরিনাথ, প্রকৃত নাম হরিনাথ মজুমদার, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং পথিকৃৎ। উনিশ শতকের মধ্যভাগে যখন ব্রিটিশ উপনিবেশের চাপে বাঙালি জাতি সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছিল, তখন তিনি একটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং সমাজ সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কেবল সংবাদ পরিবেশনই নয়, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সাধারণ মানুষের সমস্যা তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অনন্য।

কাঙাল হরিনাথের জন্ম ১৮৩৩ সালে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার অন্তর্গত গ্রাম চাপড়াতে। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান হওয়ায় তাঁর শৈশব ছিল অভাব-অনটনে ভরা। তিনি প্রথাগত শিক্ষায় খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেননি। তবে নিজের প্রচেষ্টায় বাংলাসহ সংস্কৃত ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত করেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে জ্ঞানার্জনের প্রবল তৃষ্ণা ছিল, যা তাঁকে স্বশিক্ষিত করে তোলে।

১৮৬৩ সালে, হরিনাথ “গ্রামবার্তা প্রকাশিকা” নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। এটি ছিল গ্রামের সাধারণ মানুষের সমস্যা, তাঁদের জীবনের কথা এবং সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরার একটি প্ল্যাটফর্ম। তাঁর এই পত্রিকা একসময় সাপ্তাহিক রূপ নেয় এবং তা পুরো বাংলায় জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ব্রিটিশ শাসনের দুর্নীতি, জমিদারদের অত্যাচার এবং সমাজের নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি তাঁর কলমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন।

“গ্রামবার্তা প্রকাশিকা”র বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এর সহজ-সরল ভাষা। হরিনাথ বিশ্বাস করতেন, সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য সাধারণ মানুষের কাছে সত্য তুলে ধরা। তাই তাঁর পত্রিকার ভাষা ছিল প্রাঞ্জল এবং সহজবোধ্য। তিনি গ্রামের কৃষক, শ্রমিক এবং দরিদ্র মানুষের জন্য লিখতেন, যা তখনকার অভিজাতদের সাংবাদিকতার ধরন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল।

কাঙাল হরিনাথ কেবল সাংবাদিকই ছিলেন না; তিনি ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। তিনি জমিদারদের শোষণ এবং মহাজনদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তাঁর পত্রিকার মাধ্যমে তিনি কৃষকদের অধিকার রক্ষা এবং তাঁদের কষ্টের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষাই পারে সমাজকে পরিবর্তন করতে। তাই গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন।

হরিনাথ নারীদের শিক্ষা এবং অধিকারেও জোর দিয়েছিলেন। যদিও সে সময় নারী শিক্ষা নিয়ে সামাজিকভাবে প্রচুর বাধা ছিল, তবুও তিনি এ বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারীদের উন্নয়ন ছাড়া সমাজের প্রকৃত অগ্রগতি সম্ভব নয়।

সাংবাদিকতার পাশাপাশি হরিনাথ সাহিত্যচর্চাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর লেখায় সমাজের বাস্তবতা, মানুষের দৈনন্দিন জীবন এবং তাদের সংগ্রামের চিত্র উঠে আসে। তিনি বিভিন্ন কবিতা, গান এবং প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি নিজে একজন গীতিকার এবং সুরকার ছিলেন। তাঁর রচিত গানগুলো মানুষের হৃদয়ে দেশপ্রেম এবং সমাজ সংস্কারের জন্য উদ্বুদ্ধ করত।

তাঁর দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের জন্য তিনি নিজেকে “কাঙাল” বলে অভিহিত করতেন। তবে তাঁর দারিদ্র্য কখনোই তাঁর মানসিক শক্তি এবং সৃজনশীলতার উপর প্রভাব ফেলেনি। তাঁর “কাঙাল” পরিচিতি তাঁকে সাধারণ মানুষের আরও কাছাকাছি নিয়ে যায়। তিনি তাঁদের দুঃখ-দুর্দশা নিজের জীবনের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলেছিলেন।

হরিনাথ ব্রিটিশ শাসনের অবিচার এবং তাদের শোষণমূলক নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তাঁর পত্রিকায় তিনি এই শোষণ, বিশেষ করে নীলকর সাহেবদের অত্যাচার, তুলে ধরেছিলেন। নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময় তাঁর কলম হয়ে ওঠে এক শক্তিশালী অস্ত্র।

গ্রামবার্তা প্রকাশিকা প্রকাশিত হওয়ার পর এটি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও, জমিদার এবং ব্রিটিশ শাসকদের ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হরিনাথকে নানাভাবে বাধা দেওয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত আর্থিক সংকটের কারণে পত্রিকাটি বন্ধ করতে হয়। তবে তাঁর সাংবাদিকতার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি ছিল।

১৮৯৬ সালে হরিনাথের মৃত্যু হয়। তাঁর কাজ এবং আদর্শ বাঙালির সাংবাদিকতার ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছে। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে সাংবাদিকতা কেবল তথ্য প্রকাশের মাধ্যম নয়; এটি সমাজের পরিবর্তনের একটি হাতিয়ার। তাঁর সাহসী এবং সৎ সাংবাদিকতার ধারা আজও অনুসরণীয়।

কাঙাল হরিনাথের জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি, নিষ্ঠা এবং ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সমাজে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা সম্ভব। তাঁর কাজ এবং সংগ্রাম আজও আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়। তিনি কেবল একজন সাংবাদিক বা লেখক নন; তিনি একজন যোদ্ধা, যিনি সাধারণ মানুষের অধিকারের জন্য জীবনভর লড়াই করেছেন।

কাঙাল হরিনাথ তাঁর সাংবাদিকতায় যে বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছিলেন, তা ছিল সেই সময়ের জন্য এক নতুন দিগন্ত। তখনকার সমাজে সাংবাদিকতা মূলত অভিজাত শ্রেণির কণ্ঠস্বর হিসেবেই পরিচিত ছিল। জমিদার, ব্রিটিশ প্রশাসন ও ধনিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু হরিনাথ এই প্রথার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকতাকে সাধারণ মানুষের সমস্যার কণ্ঠস্বর করে তোলেন। তিনি মনে করতেন, সাংবাদিকতার মাধ্যমে কৃষক, শ্রমিক ও সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষের সমস্যাগুলোকে তুলে ধরা প্রয়োজন।

“গ্রামবার্তা প্রকাশিকা”র প্রতিটি সংখ্যায় তখনকার সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ও সমসাময়িক বিষয়গুলো উঠে আসত। এর মধ্যে জমিদারদের অত্যাচার, ব্রিটিশ শাসকদের শোষণ, মহাজনদের চক্রান্ত এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার দুঃখ-কষ্ট ছিল মূল প্রতিপাদ্য। হরিনাথ তাঁর কলামে গ্রামের কৃষকদের শোষণ এবং নীল চাষের ভয়াবহতা তুলে ধরেন, যা ব্রিটিশ শাসক ও স্থানীয় জমিদারদের কাছে অপছন্দনীয় হয়ে ওঠে।

তাঁর সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি সমাজের দুর্নীতি, কুসংস্কার, বর্ণবৈষম্য এবং নারী অধিকার নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, কেবল সংবাদ পরিবেশন নয়, বরং এর মাধ্যমে সমাজে সচেতনতা তৈরি করা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাই সাংবাদিকতার আসল লক্ষ্য।

নীল বিদ্রোহ বাংলার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন। নীলচাষীদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার এবং তাদের শোষণের কাহিনী কাঙাল হরিনাথ তুলে ধরেন তাঁর পত্রিকায়। নীলচাষীদের দুরবস্থা এবং তাদের প্রতি ব্রিটিশ ও জমিদারদের নিষ্ঠুর আচরণ নিয়ে তাঁর প্রতিবেদনগুলো মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।

নীল বিদ্রোহের সময় হরিনাথ তাঁর কলমকে একটি শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি “গ্রামবার্তা প্রকাশিকা”র মাধ্যমে নীল চাষের শোষণ ও অত্যাচারের বিষয়টি জনসম্মুখে আনেন। সাধারণত, নীলকর সাহেবদের ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না। কিন্তু হরিনাথ সাধারণ কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের সমস্যা তুলে ধরতে দ্বিধা করেননি। তিনি বিভিন্ন প্রতিবেদনে চাষিদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী বর্ণনা করেন এবং ব্রিটিশ শাসনের শোষণমূলক নীতিগুলোর প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রতিবেদনগুলো ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। তাঁর লেখার মাধ্যমে কৃষকদের মধ্যে প্রতিরোধের চেতনা জাগ্রত হয় এবং তাদের একত্রিত করে আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর এই ভূমিকা তাঁকে শুধু সাংবাদিকই নয়, একজন সমাজসংস্কারক এবং সংগ্রামী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করে।

কাঙাল হরিনাথের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর ভাষার সহজতা। তিনি গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের কথা সহজ, সরল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করতেন। “গ্রামবার্তা প্রকাশিকা”র প্রতিটি লেখায় গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন জীবন এবং তাঁদের সংকটগুলো উঠে আসত। তিনি মনে করতেন, সাংবাদিকতার ভাষা এমন হওয়া উচিত যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। এর ফলে তাঁর পত্রিকা গ্রামবাংলার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

হরিনাথ সাংবাদিকতার পাশাপাশি গীতিকার, সুরকার এবং কবি হিসেবেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বহু গান রচনা করেছিলেন, যা পরবর্তীতে গ্রামবাংলার মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়। তাঁর গানগুলোয় সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম, প্রেম এবং সমাজের অসঙ্গতিগুলো প্রতিফলিত হয়। বিশেষ করে, তাঁর রচিত “পল্লীগীতি” এবং “বাউল গান” সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।

তাঁর রচনাগুলো কেবল সাহিত্যিক গুরুত্বের জন্যই নয়, বরং সামাজিক পরিবর্তন এবং মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যও তা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, সঙ্গীত এবং সাহিত্য সমাজ পরিবর্তনের শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে।

দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও হরিনাথের মানবিকতা ছিল গভীর। তিনি সবসময় অসহায় এবং দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। তিনি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে কখনো পিছপা হননি। “কাঙাল” উপাধিটি নিজেই ধারণ করে তিনি দেখিয়েছেন, দারিদ্র্য মানুষকে মহৎ হওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। বরং তিনি প্রমাণ করেছেন যে, আত্মনিবেদন এবং সৎ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দারিদ্র্যকে জয় করা সম্ভব।

হরিনাথ মজুমদারের কাজ ও আদর্শ বাংলা সাংবাদিকতার ইতিহাসে একটি স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। তিনি সাংবাদিকতাকে কেবল তথ্যানুসন্ধান এবং পরিবেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং সাংবাদিকতাকে সমাজের সমস্যার সমাধান ও জনমতের পরিবর্তনের হাতিয়ারে রূপান্তরিত করেছিলেন।

তাঁর সাহসিকতা এবং নীতিবোধ নতুন প্রজন্মের সাংবাদিক ও লেখকদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। তাঁর দেখানো পথ ধরে পরবর্তীতে আরও অনেক সাংবাদিক এবং সমাজ সংস্কারক এগিয়ে এসেছেন।

১৮৯৬ সালে কাঙাল হরিনাথের জীবনাবসান ঘটে। কিন্তু তাঁর কাজ এবং আদর্শ তাঁকে চিরকাল স্মরণীয় করে রেখেছে। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন যে, কঠিন পরিস্থিতিতেও নৈতিকতা এবং সাহস বজায় রেখে সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব।

কাঙাল হরিনাথ ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন সমাজের অবহেলিত মানুষের জন্য। সাংবাদিকতা, সাহিত্য, সংগীত এবং সমাজসেবার মাধ্যমে তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অগ্রগতিতে বিশাল অবদান রেখেছেন। তিনি ছিলেন এমন একজন পথিকৃৎ, যিনি নিজের সীমিত সম্পদ এবং অসুবিধা সত্ত্বেও সমাজের জন্য অবিচলভাবে কাজ করে গেছেন। তাঁর জীবন ও কাজ আমাদের দেখায় যে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো কখনো বৃথা যায় না।

লেখক পরিচিতি  : উজ্জ্বল হোসাইন, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স (ব্যাচ ২০২১), পিআইবি।

উত্তাল সাগর, শক্তি সঞ্চয় করছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫, ১০:০৬ পূর্বাহ্ণ
উত্তাল সাগর, শক্তি সঞ্চয় করছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’

পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘মোন্থা’ আরও উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে শক্তি সঞ্চয় করছে। এটি ঘনীভূত হয়ে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। সোমবার (২৭ অক্টোবর) রাতে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ৮ নম্বর বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, সোমবার মধ্যরাতে ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১৩০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ১২৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ১১৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ১১৭৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি আরও উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এটি মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) সন্ধ্যা অথবা রাত নাগাদ ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় ৮৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ২ নম্বর (পুন.) ২ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে তাদের গভীর সাগরে বিচরণ না করার জন্য কঠোরভাবে বারণ করা হয়েছে।

হাঁটা বন্ধ করবেন না, কেনো হাঁটবেন

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫, ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ
হাঁটা বন্ধ করবেন না, কেনো হাঁটবেন

হাঁটা বন্ধ করবেন না যেন, মস্তিষ্ক নয়, ডিমেনশিয়া শুরু হয় আপনার পা থেকে! বিশ্বজুড়ে বয়স্ক মানুষের অক্ষমতা ও নির্ভরশীলতার প্রধান কারণ হিসেবে ডিমেনশিয়া এখন এক ভয়াবহ বাস্তবতা। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি ৭০ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত ছিলেন, এবং প্রতিবছর নতুন করে আরও প্রায় ১ কোটি মানুষ এতে ভোগেন। অধিকাংশ মানুষই মনে করেন, মস্তিষ্ক সচল রাখাই ডিমেনশিয়া প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি। কিন্তু ভারতের অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল সায়েন্সেস (এইমস) প্রশিক্ষিত স্নায়ুশল্য বিশেষজ্ঞ ডা. অরুণ এল. নাইক জানালেন চমকপ্রদ তথ্য—ডিমেনশিয়ার সূত্রপাত নাকি মস্তিষ্কে নয়, পা থেকেই!
ডিমেনশিয়া কী?
ডিমেনশিয়া কোনো একক রোগ নয়; এটি স্মৃতি, চিন্তাশক্তি ও দৈনন্দিন কাজের সক্ষমতাকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে এমন একাধিক স্নায়ুরোগের সামষ্টিক নাম। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি আরও জটিল হয়ে ওঠে এবং জীবনের মান নষ্ট করে দেয়। তবে সময়মতো নির্ণয়, যত্নশীল পরিচর্যা, জীবনযাপনে পরিবর্তন ও চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীর অবস্থা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
ডিমেনশিয়া শুরু হয় পা থেকে
ডা. নাইক এক ভিডিও বার্তায় বলেন, “আপনি কি জানেন, ডিমেনশিয়া আসলে শুরু হয় আপনার পা থেকে? শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা পায়ের পেশিকে দুর্বল করে, যার ফলে স্যারকোপেনিয়া বা পেশি ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ে। এখানেই শুরু হয় বিপদ। গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্বল পায়ের কারণে জ্ঞানগত ক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পায় এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন, শরীরের সক্রিয় পেশি এমন রাসায়নিক উৎপাদন করে যা মস্তিষ্ককে সচল রাখে। এই রাসায়নিকগুলোর নাম ব্রেইন-ডিরাইভড নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর (BDNF), যা মস্তিষ্কের স্মৃতিনির্ভর অংশ হিপোক্যাম্পাসে সংযোগ বৃদ্ধি করে। শক্তিশালী পা শুধু ভারসাম্য বজায় রাখে না, বয়স বাড়লেও পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমায়। “৬৫ বছরের পর পড়ে যাওয়াই সবচেয়ে বিপজ্জনক,” বলেন ডা. নাইক।
তিনি ২০২০ সালের Neurology সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণার উদাহরণ দেন, যেখানে দেখা গেছে, যাদের হাঁটার গতি কম, তাদের মস্তিষ্কের আকারও ছোট এবং জ্ঞানীয় ক্ষমতা হ্রাসের ঝুঁকি বেশি। “হাঁটা শুধু শরীরচর্চা নয়, এটি পুরো মস্তিষ্কের এক অনুশীলন,” যোগ করেন তিনি।
কীভাবে হাঁটা মস্তিষ্ককে সুরক্ষিত রাখে
হাঁটা এমন এক সহজ ব্যায়াম যা শরীর ও মস্তিষ্ক দুটিকেই সক্রিয় রাখে। ডা. নাইক বলেন, “প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে যুক্ত থাকে মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব, সেরিবেলাম, স্পাইনাল কর্ড ও স্নায়ু প্রতিক্রিয়ার সমন্বয়।” হাঁটা রক্তসঞ্চালন বাড়ায়, যা মস্তিষ্কে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ সরবরাহ করে এবং টক্সিন দূর করে। তিনি আরও বলেন, “হাঁটার ধরনে বা ভারসাম্যে পরিবর্তন দেখা গেলে সেটি মস্তিষ্কের আগাম সতর্ক সংকেত। এটি প্রায়ই স্মৃতি সমস্যার বছরখানেক আগেই দেখা দেয়।” হাঁটা নিউরোপ্লাস্টিসিটির এক জীবন্ত উদাহরণও বটে। “হাঁটার সময় শরীরে BDNF সক্রিয় হয়, যা নিউরনগুলোর সংযোগ শক্তিশালী করে,” বলেন ডা. নাইক।
কীভাবে ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ করবেন ডা. নাইক কয়েকটি সহজ অভ্যাসের পরামর্শ দিয়েছেন, যা নিয়মিত চর্চা করলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বজায় থাকে এবং ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটুন। ভারসাম্য রক্ষার ব্যায়াম যেমন এক পায়ে দাঁড়ানো বা সরলরেখায় হাঁটার অভ্যাস করুন। হাঁটার সময় কথা বলা বা হালকা মানসিক কাজ করুন—এটি মস্তিষ্কের সমন্বয় ক্ষমতা বাড়ায়। নিয়মিত পায়ের পেশির ব্যায়াম করুন, এটি মস্তিষ্কের জন্য একপ্রকার ‘বিমা’।
দীর্ঘ সময় বসে থাকা পরিহার করুন; প্রতি ঘণ্টায় কিছুটা নড়াচড়া করুন। তিনি বলেন, “যখন আপনার পা ধীরে ধীরে কাজ হারায়, তখন মস্তিষ্কও তার পথ অনুসরণ করে। আপনার হাঁটার গতি বজায় রাখুন, তাহলেই সুরক্ষিত থাকবে মস্তিষ্ক।”
ডা. নাইক আরও পরামর্শ দেন, পেশির গঠন রক্ষায় প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করা জরুরি। তার মতে, কখনোই দেরি হয়ে যায় না। “গবেষণায় দেখা গেছে, ষাট বছর বয়সেও হাঁটা ও ব্যায়াম শুরু করলে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি অনেক কমে যায়। মনে রাখবেন, শক্ত পা মানেই তীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক। স্যারকোপেনিয়া মাথা পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই সচেতন হোন—চল্লিশের কোঠা থেকেই শুরু করুন।”
সর্বোপরি, সক্রিয় থাকা শুধু চলাফেরার বিষয় নয়; এটি মস্তিষ্ককে তরুণ রাখার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম ও সুষম খাদ্য—এই তিন অভ্যাসই হতে পারে বার্ধক্যের ডিমেনশিয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ।

বন্ধ হচ্ছে সরকারি অর্থে বিদেশ ভ্রমণ

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫, ৯:৫৫ পূর্বাহ্ণ
বন্ধ হচ্ছে সরকারি অর্থে বিদেশ ভ্রমণ

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের কাজ শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। সোমবার (২৭ অক্টোবর) এ-সংক্রান্ত এক পরিপত্র জারি করে অর্থ বিভাগ। পরিপত্রে বলা হয়েছে, কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগ অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ চাইতে পারবে না। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, চলমান সংকোচনমূলক নীতির প্রেক্ষাপটে গত কয়েক বছরের মতো সংশোধিত বাজেটেও ব্যয় সাশ্রয় বা কৃচ্ছ্রসাধন নীতি অব্যাহত রাখতে হবে। এর আওতায় বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি কেনাসহ বেশ কিছু ব্যয় বন্ধ থাকবে। এ নীতি অনুসরণ করে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে তাদের সংশোধিত বাজেটের প্রাক্কলন আগামী ৯ নভেম্বরের মধ্যে অর্থ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে।
পরিপত্রে বলা হয়েছে, সংশোধিত বাজেট প্রাক্কলন অবশ্যই মূল বাজেটে বরাদ্দের মধ্যেই থাকতে হবে। কোনোভাবেই অতিরিক্ত বরাদ্দ দাবি করা যাবে না। তবে সরকারের অগ্রাধিকার কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রয়োজনে মূল বাজেটে বরাদ্দের ব্যয়সীমার মধ্যে থেকে একই ধরনের বিভিন্ন কাজে বরাদ্দ কমানো বা বাড়ানো যাবে। কিন্তু উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থ অব্যয়িত থাকবে বলে অনুমিত হলে ওই অর্থ কোনোক্রমেই পরিচালন বাজেটে স্থানান্তর করা যাবে না।
এতে আরও বলা হয়, সংশোধীত বাজেটেও ব্যয় সাশ্রয় বা কৃচ্ছ্রসাধন নীতির আওতায় সরকারি খরচে সব ধরনের বৈদেশিক ওয়ার্কশপ ও সেমিনারে অংশগ্রহণ বন্ধ থাকবে। তবে অত্যাবশ্যকীয় বিবেচনায় সীমিত আকারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে বিদেশ ভ্রমণ করা হবে। তা ছাড়া কেনা যাবে না গাড়ি, জাহাজ ও বিমান। তবে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে পরিচালন বাজেটের আওতায় ১০ বছরের পুরোনো গাড়ির প্রতিস্থাপন হিসেবে নতুন গাড়ি কেনা যাবে। এমনকি পরিচালন বাজেটে আওতায় ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ খরচও বন্ধ রাখতে হবে। তবে উন্নয়ন বাজেটের আওতায় শর্তসাপেক্ষে ব্যয় করা যাবে। আরও কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় স্থগিত রাখা হয়েছে আবার গুরুত্ব বিবেচনায় এসব ক্ষেত্রে ব্যয়ে কিছুটা ছাড়ও দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) প্রণয়নে প্রকল্পের সংখ্যা সীমিত রাখাসহ ১৩ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে সরকারি ব্যয় বেড়ে গেছে। তাই কোনো খাতে ব্যয় সাশ্রয়ের সুযোগ রয়েছে কি না, তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে সংশোধিত বাজেটে এর প্রতিফলন দেখা যাবে। সাধারণত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে বিশেষ করে মার্চে সরকার জাতীয় বাজেট সংশোধন করে। তবে এবার ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন থাকায় আগেভাগে বাজেট সংশোধন করা হচ্ছে।