
এনবিআর ভাগ করে রাজস্বনীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে আলাদা যে দুটি বিভাগ হচ্ছে, সেখানে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজস্ব আহরণে অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা প্রাধান্য পেতে যাচ্ছেন। দুই বিভাগেই রাজস্ব আদায় কাজে অভিজ্ঞদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। রাজস্বনীতি ও ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ সংশোধনের খসড়ায় এমন প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।
গত মে মাসে জারি করা অধ্যাদেশ এনবিআর কর্মীদের আন্দোলনের মুখে স্থগিত করে সরকার। আন্দোলনকারীদের মূল দাবি ছিল– পদায়নের ক্ষেত্রে রাজস্ব কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠক করে অধ্যাদেশ সংশোধনে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটির সংশোধন প্রস্তাব আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে উপস্থাপিত হচ্ছে।
মূল অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল, রাজস্বনীতি বিভাগে সচিব পদে সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যে কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ দিতে পারবে।
সংশোধিত অধ্যাদেশের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সামষ্টিক অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি, রাজস্বনীতি, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বা রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। অন্যদিকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বা আদায় বিভাগের সচিব পদে রাজস্ব আহরণ কাজে অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সংশোধিত অধ্যাদেশে বলা হয়েছে,
শুধু রাজস্ব সংগ্রহে অভিজ্ঞতা থাকা ব্যক্তি এ পদে নিয়োগ পাবেন।
১১টি ধারায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন-বিয়োজন করে সংশোধিত অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। খসড়া অনুযায়ী সচিব পদ বাদে দুই বিভাগের অন্যান্য পদে রাজস্ব আহরণের অভিজ্ঞদের নিয়োগের পরিধি মূল অধ্যাদেশের তুলনায় বেড়েছে। রাজস্বনীতি বিভাগে নীতিসংক্রান্ত কাজে রাজস্ব আহরণে অভিজ্ঞরা নিয়োগ পাবেন। মূল অধ্যাদেশে এখানে সরকারের অন্য বিভাগ থেকে পদায়নের সুযোগ ছিল। তবে রাজস্বনীতি বিভাগের অন্যান্য অনুবিভাগে জনপ্রশাসন, হিসাব-নিরীক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন কাজে অভিজ্ঞরা নিয়োগ পাবেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামের দুটি বিভাগ করে গত ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে অন্তর্বর্তী সরকার। অধ্যাদেশ অনুযায়ী রাজস্বনীতি প্রণয়ন করবে একটি বিভাগ এবং আদায় করবে আরেক বিভাগ। অধ্যাদেশ জারির পর এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়, তাদের বদলে প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তারা নিয়োগে প্রাধান্য পাবেন। এ আশঙ্কা থেকেই ‘কমপ্লিট শাটডাউন’সহ নানা কর্মসূচি পালন করেন তারা। দীর্ঘ সময়ের এই আন্দোলনে প্রায় অচল হয়ে পড়ে রাজস্ব খাত। সাধারণ মানুষ ও করদাতারা এ সংস্থার সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। সরকারের শীর্ষ মহল থেকে অধ্যাদেশ সংশোধন এবং তাদের আন্দোলন বন্ধের অনুরোধ করলেও তারা শোনেননি। অবশেষে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় এনবিআরের আন্দোলন শেষ হয়। এক পর্যায়ে সবাই কাজে ফিরে যেতে বাধ্য হন। তবে আন্দোলনের জেরে এনবিআরের বেশ কিছু কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। অনেক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়।
অধ্যাদেশ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে তা সংশোধনের জন্য বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানকে আহ্বায়ক করে গত ৩০ জুন পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী অধ্যাদেশ সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল সমকালকে বলেন, ক্যাডারে ক্যাডারে যাতে বিরোধ না থাকে, সংশোধিত অধ্যাদেশের প্রস্তাবে তা বিবেচনা করা হয়েছে। রাজস্বনীতি বিভাগে সচিব পদ উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। এখানে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার এবং একই সঙ্গে কর, শুল্ক ও আবগারি ক্যাডারের কর্মকর্তারা সচিব হতে পারবেন। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব পদে রাজস্ব আহরণসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞদের মধ্য থেকেই নিয়োগ দেওয়া হবে।
খসড়ায় যেসব গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনের প্রস্তাব
সরকার উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্বনীতি বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ করবেন বলে বিদ্যমান অধ্যাদেশে উল্লেখ করা হয়। বিদ্যমান অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, রাজস্বনীতি বিভাগের বিভিন্ন পদে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, কাস্টমস, অর্থনীতি, ব্যবসা প্রশাসন, গবেষণা ও পরিসংখ্যান, প্রশাসন, নিরীক্ষা ও হিসাব এবং আইনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পূরণযোগ্য হবে। তবে এ-সংক্রান্ত উপধারা সংশোধন করে রাজস্বনীতি বিভাগের আয়কর নীতি, দ্বৈতকর পরিহার চুক্তি, আন্তর্জাতিক চুক্তি ও মতামত শুল্কনীতি, মূল্য সংযোজন করনীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও কাস্টমস-সংক্রান্ত চুক্তি অনুবিভাগের বিভিন্ন পদে রাজস্ব আহরণ-সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
একই সঙ্গে রাজস্বনীতি বিভাগের অন্যান্য অনুবিভাগের পদে জনপ্রশাসন, অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতি গবেষণা ও পরিসংখ্যান, হিসাব ও নিরীক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ এবং আইন প্রণয়ন-সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা বা ব্যক্তিদের মধ্য থেকে নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের আয়কর, মূল্য সংযোজন কর এবং কাস্টমস আইন বাস্তবায়ন এবং মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা-সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের বিভিন্ন পদে শুল্ক ও আবগারি এবং কর ক্যাডারে কর্মরত জনবলের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়ার বিধান রাখা হয়। সংশোধিত অধ্যাদেশের খসড়ায় এ-সংক্রান্ত উপধারা সংশোধন করে আয়কর, মূল্য সংযোজন কর, কাস্টমস আইন বাস্তবায়ন এবং মাঠ পর্যায়ের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা-সংশ্লিষ্ট অনুবিভাগের বিভিন্ন পদে রাজস্ব আহরণ-সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক অনুবিভাগের বিভিন্ন পদ প্রশাসন, কর এবং শুল্ক ও আবগারি ক্যাডার এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মচারীদের মধ্য থেকে পূরণ করার বিধান রয়েছে। এ-সংক্রান্ত উপধারা সংশোধন করে এসব পদে রাজস্ব আহরণ ও জনপ্রশাসন-সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের মধ্যে থেকে পূরণ করার প্রস্তাব করা হয়।
অধ্যাদেশের নবম ধারায় বলা হয়েছে, রাজস্ব বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ প্রতিষ্ঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিদ্যমান জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হবে। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জনবল রাজস্বনীতি বিভাগে পদায়ন করা যাবে। সংশোধন প্রস্তাবে এনবিআরের জনবল রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগে ন্যস্ত হওয়ার বিষয়টি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। আর এখান থেকে প্রয়োজনীয় জনবল বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে রাজস্বনীতি বিভাগে পদায়ন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পর্যালোচনা হবে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আজ সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি নিয়ে পর্যালোচনা হবে। কোন কমিশনের কতটি সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে, সেই চিত্র তুলে ধরা হবে। আশু বাস্তবায়নযোগ্য ৩৬৭টি সুপারিশের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩৭টি সুপারিশ এরই মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান সমকালকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। এজন্য এখন থেকে উপদেষ্টা পরিষদের প্রতিটি বৈঠকে কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি বিষয়ে ১ নম্বর এজেন্ডা থাকছে।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। সংবিধান সংস্কার কমিশন ছাড়া বাকি ১০টি কমিশনের মোট ৩৬৭টি সুপারিশ আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।