
পৃথিবীর কোনো মানচিত্রেই তার গন্তব্য ছিলো না। না ছিলো কোনো বাঁধা সময়, না নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য। যে মানুষটা শুধু হেঁটেই চলেছে বছরের পর বছর লোকেরা তাকে ক্লান্তহীন পথিক বলে ডাকে। তার আসল নাম? সেটা কেউ জানে না। কেউ একজন বলেছিল, তার নাম হয়তো আদিত্য। কেউ বলেছে, আহসান। কিন্তু সে শুধু একবার বলেছিল, আমার নামটাও যাত্রাপথে ফেলে এসেছি। এখন আমি শুধু পথেরই।
সে এসেছিল ছোট্ট এক নদীঘেরা গ্রামে, নাম ছিল অচিন্তপুর। সন্ধ্যার আগ মুহূর্ত। নদীর তীরে বসে কিছু বালক খেলছিল, আর একপাশে গরু ঘরে ফিরছিল খালি পেট নিয়ে। পথিক এসেই বসে পড়েছিল নদীর ঘাটে। তার পরনে ধুলিধূসর পাঞ্জাবি, হাতে বাঁশের লাঠি, কাঁধে ফাটা ব্যাগ। চোখ দুটো ক্লান্ত, অথচ শান্তির পরিপূর্ণতায় ভরপুর।
তখনই তার সাথে প্রথম দেখা হয় গ্রামের একমাত্র লাইব্রেরির দায়িত্বপ্রাপ্ত তরুণী—নিভা। বয়স বাইশ-তেইশ হবে। চোখে সরলতা আর কণ্ঠে দৃঢ়তা। সে লাইব্রেরির পুরোনো বই গুছিয়ে ফিরছিল। পথিককে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল,
আপনি এখানে বসে আছেন, কোথাও যেতে হবে না?
পথিক হেসে বলল, চলতে চলতেই তো থামি মাঝে মাঝে। এই থামাগুলোই আমার বিশ্রাম।
নিভা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়?
পথিক উত্তর দিল, যেখানেই রাত হয়, সেখানেই আমার বাড়ি।
আপনি কী করেন?
মানুষ দেখি, গল্প শুনি, ভালোবাসা খুঁজি।
সেদিনই প্রথম, তারপর থেকে নিভা প্রায় প্রতিদিনই কিছু সময় নদীর ঘাটে বসে তার সঙ্গে কথা বলত। গল্প শুনত। জানতে চাইত, সে এতো হেঁটে বেড়ায় কেন? কোথা থেকে এসেছে? কিছুই জানা যেত না। সে শুধু বলত, আমি ভালোবাসা খুঁজি, যেটা হারিয়ে ফেলেছি অনেক বছর আগে।
দিন যেতে লাগল। পথিক থাকতেই লাগল অচিন্তপুরে। গ্রামের লোকজন শুরুতে সন্দেহ করলেও পরে তাকে আপন করে নেয়। কেউ তাকে খেতে দেয়, কেউ চা বানিয়ে আনে। নিভার লাইব্রেরির পাশেই একটা পুরোনো ভাঙা ঘর সেটাকেই সে রাতের আশ্রয় বানাল।
নিভা মাঝে মাঝে তার জন্য বই এনে দিতো রবীন্দ্রনাথ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হুমায়ূন আহমেদ, এমনকি জীবনানন্দের কবিতা।
পথিক বলত, এই লেখকেরা তো আমাকেই লিখেছে কোনো এক অচেনা, অদৃশ্য পথিককে।
একদিন সন্ধ্যায় নিভা বলল,
আপনার গল্প শুনে মনে হয়, আপনি কাউকে খুব ভালোবেসেছিলেন।
পথিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
ভালোবাসা তো কখনো চলে যায় না, আমরা শুধু তাকে হারিয়ে ফেলি। আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম—সেই নারীকে, যে আমার চোখে আকাশ দেখত, আমার গল্পে জীবন খুঁজত। সে বলত, একদিন আমিও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্পকার হবো। কিন্তু সেই স্বপ্নের পথে আমি একাই রয়ে গেলাম।
সে কোথায়?
আমি জানি না। হয়তো কোনো গ্রামে সে এখনো অপেক্ষা করে, হয়তো অন্য কারো পাশে বসে চুপ করে থাকে। আমি শুধু হাঁটি, যদি কখনো তার অপেক্ষার ছায়াটাও পাই।
নিভার চোখে পানি চলে এল। সে বুঝতে পারল, এই পথিক শুধু ক্লান্তহীন না, এক ভাঙা হৃদয়ের গল্পও বয়ে বেড়ায় সে।
গ্রামের একটি মেলার আয়োজন হল। সবাই আনন্দে মেতে উঠল। পথিককেও ডাকা হলো। সে গান গাইল—পুরনো বাউল গান, হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা সুরে। সবাই চুপ করে শুনল। গানের শেষে নিভা এগিয়ে গিয়ে তার পাশে দাঁড়াল। হাতে একটা ছোট্ট চিঠি ধরিয়ে দিল।
এটা আমার জন্য?
হ্যাঁ। এবার আপনিই পড়বেন।
পথিক ঘরে ফিরে চিঠি খুলল-
আপনার পথচলার গল্প শুনে মনে হয়, আপনি শুধু কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন না, আপনি নিজেকেও খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
আমি জানি না আপনি কোথা থেকে এসেছেন, জানি না কোথায় যাবেন।
তবে আমি চাই, এই গ্রামটাই আপনার গন্তব্য হোক।
আমি চাই, আপনি আর ক্লান্ত না হন।
আপনি থাকতে পারেন এখানে। আমার পাশে।
পথিক অনেকক্ষণ ধরে চিঠিটা ধরে রাখল। তার চোখে জল। খুব ধীরে সে নদীর ঘাটে গিয়ে বসল। চারপাশে নিস্তব্ধতা। মাথার ওপর চাঁদের আলো। সে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
পরদিন সকালে কেউ আর তাকে খুঁজে পেল না।
নিভা ছুটে গেল নদীর পাড়ে, লাইব্রেরিতে, ভাঙা ঘরে। কোথাও নেই। কেবল ঘরের একপাশে একটা পুরোনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেল। নাম লেখা ক্লান্ত পথিকের ক্লান্তিহীন ভালোবাসা।
ভেতরে লেখা ছিল-
আমি ভালোবাসতে পারি, কিন্তু থামতে পারি না।
ভালোবাসা মানে শুধু কারো পাশে থাকা নয়,
অনেক সময় দূরে হেঁটে যাওয়াটাই আসল ভালোবাসা
যাতে কেউ অপেক্ষায় না থাকে, কষ্ট না পায়।
নিভা, তুমি আমার ভালোবাসার শেষ ছায়া।
আমি জানি, তুমি অপেক্ষা করবে না।
তবু যদি কখনো নদীর ঘাটে বসে কেউ বলে,
আমি তাকে চিনতাম, তবে জানবে, আমি ফিরে এসেছিলাম একবার খুব নিঃশব্দে।
বছর ঘুরে গেছে। নদীর পাড়ে এখনো বসে থাকে নিভা। কারো হাতে পুরোনো পাণ্ডুলিপি থাকলে সে পড়ে শোনায় সেই গল্প
ক্লান্ত পথিকের ক্লান্তিহীন ভালোবাসা
যে ভালোবাসা থামে না, অপেক্ষা চায় না, শুধু হেঁটে চলে যায় কোনো না কোনো হৃদয়ের আকাশে।
লেখক পরিচিতি : উজ্জ্বল হোসাইন, চাঁদপুর।