ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইনে ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও আইনের তোয়াক্কা না করে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার শতাধিক ইটভাটায় প্রকাশ্যে কয়লার পরিবর্তে দৈনিক পুড়ছে ২শ’ টন কাঠ। আর এসব কাঠ ইটভাটায় সরবরাহ করছে কাঠ ব্যবসায়ীচক্র।
এতে একদিকে যেমন ন্যাড়া হচ্ছে সংরক্ষিত বনভূমি ও পাহাড়। সেইসাথে ধুলাবালির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশেপাশের ক্ষেতের ফসল উৎপাদন। অন্যদিকে ভাটার কালো ধোঁয়ায় বাতাসে বেড়েই চলেছে বিষাক্ত কার্বনডাইঅক্সাইট গ্যাস। ফলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ ভাটা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়ায় চোখ, ত্বক ও ফুসফুসের কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয় মানুষজন।
এদিকে সংরক্ষিত বন ও বনভূমি দেখভাল এবং রক্ষায় বন বিভাগ থাকলেও তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে রাঙ্গুনিয়ার বনাঞ্চল দিন দিন বৃক্ষশূন্য হওয়ার পাশাপাশি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গড়ে উঠছে অবৈধ বসতি।
চলতি মৌসুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাঙ্গুনিয়ার সবুজ বনাঞ্চলের চলছে গাছ নিধনের মহোৎসব। বনাঞ্চলের গাছ কেটে লাকড়ি এবং পাহাড় কেটে মাটি ও ফসলি জমির মাটি কেটে ড্রাম্পার জিপ ও ট্রাকের মাধ্যমে বিভিন্ন ইটভাটায় পাচার করছে একটি সিন্ডিকেট। প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনদুপুরে এসব বৃক্ষ নিধনের মহোৎসব চললেও রহস্যজনক কারণে বন বিভাগ ও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। ফলে দিনের পর দিন ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে রাঙ্গুনিয়ার সবুজ পাহাড়। শুধু তাই নয়, কোথাও কোথাও বনদস্যু ও ভূমিদস্যুদের থাবায় ফসলি জমি এবং ন্যাড়া পাহাড়ও রক্ষা পাচ্ছে না। ন্যাড়া পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করায় সেখানে গড়ে উঠেছে অবৈধ বসতি ও স্থাপনা।
ইটভাটা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রতি ভাটায় ইট পোড়াতে দিন-রাতে প্রায় ১২ থেকে ১৫ মেট্রিকটন কাঠের প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে রাঙ্গুনিয়ার শতাধিক ইটভাটায় প্রতিদিন প্রায় ২’শ টন কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। আর এসব কাঠের জোগান অধিকাংশই আসে চন্দ্রঘোনার রাইখালী, রাজস্থলী ও কাপ্তাই পাল্পউড বাগানের সংরক্ষিত বনাঞ্চল, রাঙ্গুনিয়া রেঞ্জের আওতাধীন খুরুশিয়া দশমাইল, কোদলা বিটে আওতাধীন জঙ্গল নিশ্চিন্তাপুর বনাঞ্চল, ইছামতী রেঞ্জের আওতাধীন জঙ্গল পারুয়া, সোনাইমুড়ী, ইসলামপুর, রাজানগর, দক্ষিণ রাজানগর, কোদালা, পদুয়া, সরফভাটার চিরিঙা, পোমরা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের কাউখালি, রাঙামাটির সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে।
স্থানীয়রা জানান, এক শ্রেণীর বন কর্মকর্তার যোগসাজশে রাঙ্গুনিয়া বিভিন্ন সড়ক ও নদীপথে প্রতিনিয়ত বনাঞ্চলের গাছ ইটভাটায় চলে যাচ্ছে। প্রতি চাঁদের গাড়ি বা ট্রাকের চাঁদার টোকেন বন কর্তাদের কাছে জমা হওয়ার পর গাড়িগুলো ফ্রি চলাচলের অনুমতি পেয়ে যায়। রাঙ্গুনিয়া রেঞ্জ, ইছামতী রেঞ্জ, ইসলামপুর, বগাবিলী, কোদলা, খুরুশিয়া, চিরিঙ্গা, পোমরা বনবিট ও কর্ণফুলী নদীর পাশে বনজ শুল্ক ফাঁড়ি থাকলেও টোকেন দেখানোর পর কর্তারা নীরব দর্শক হয়ে যায়। অথচ বনবিভাগ ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কঠোর হলপ কখনো এভাবে প্রকাশ্যে কাঠ পাচার ও পোড়ানো সম্ভব হতো না। বন বিভাগ ও প্রশাসনের যোগসাজশ থাকার ফলে রাঙ্গুনিয়ার সবুজ পাহাড়গুলো দিনে দিনে ন্যাড়া পাহাড়ে রূপ পাচ্ছে। শুধু পাহাড়ের কাঠ পোড়ানের সুবিধার জন্য রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড় ও সংরক্ষিত বনের পাশে গড়ে উঠেছে ৬০-৬৫টি অবৈধ ইটভাটা। আবার এসব ইটভাটায় মাঝে মধ্যে লোক দেখানো অভিযানও চালানো হলেও কোন ধরনের প্রভাব নেই। ইটভাটাগুলো চলছে খেয়াল খুশিমত। তাঁদের আশঙ্কা, এভাবে কাঠ পাচার ও পোড়ানো চলতে থাকলে সংশ্লিষ্ট এলাকার বনাঞ্চল অচিরেই বৃক্ষশূন্য হয়ে যাবে এবং এতে পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে।
এ ব্যাপারে জানতে রাঙ্গুনিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা নাহিদ হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে জরুরি কাজ থাকার কারণ দেখিয়ে কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
এ বিষয়ে ইছামতী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদ হোসেন জনবল সংকটের কারণে অভিযান চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের জনবল সংকট এবং এলাকা বড় ও দূর্গম হওয়ায় কোন স্থানে অভিযান করতে পারছিনা’ তবে, কাঠ পাচার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা চলমান আছে।’
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। গত কয়েক মাসে ধরে প্রশাসনের লাগাতার অভিযানে বেশ কিছু পরিবেশ বিধ্বংসী ইটভাটা গুড়িয়ে দিয়েছি। এবং বনের কাঠ, ফসলি জমির উর্বর মাটি ও পাহাড় কেটে মাটি ব্যবহার করায় কয়েকটি ইটভাটাকে অর্থদণ্ডও দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে সব ইটভাটা নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করে চালানো হচ্ছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পরিবেশের সুরক্ষায় কঠোর, এবং
অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’

এম. মতিন, রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশের সময়: শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ । ৬:৪২ অপরাহ্ণ