সমাজের প্রতিটি ধাপেই মানুষ বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। জীবনের একেকটি পর্যায় একেক ধরনের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করে। প্রবীণ জীবনও তেমনই একটি অধ্যায়। তবে, এই জীবনের প্রতি আমাদের ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত? এ প্রশ্নটি আমাদের সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রবীণ বয়স মানেই জীবনের একটি বিশাল সময় অতিক্রম করে আসা। এই সময় একজন মানুষ তার জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, সুখ-দুঃখ, ব্যর্থতা ও সফলতার কথা নিয়ে এগিয়ে চলে। প্রবীণ ব্যক্তিরা জীবনের প্রতিটি দিক থেকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী। তাদের অভিজ্ঞতা সমাজের জন্য অমূল্য সম্পদ। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেক সময় প্রবীণ ব্যক্তিদের অবহেলা করা হয় বা তাদের কথা শোনার গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই মনোভাব পরিবর্তন জরুরি। প্রবীণ ব্যক্তিরা তাদের সারা জীবনের অর্জিত জ্ঞান দিয়ে সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন। তারা পরিবারের জন্য অভিভাবকের মতো ছায়া। পরিবারে তাদের উপস্থিতি শুধু একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করে না, বরং তারা তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
তাদের অভিজ্ঞতা সমাজের নানা সমস্যার সমাধানে কাজে আসতে পারে। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে—গ্রামীণ সমাজে প্রবীণ ব্যক্তিরা নানা প্রথা ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। তারা সমাজের সঠিক দিক নির্দেশক হিসেবেও কাজ করে।
সমাজের প্রবীণদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে, যা কখনোই এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। তারা আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক। আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার পেছনে তাদের ভূমিকা অপরিসীম। তাই প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা, যত্ন ও ভালোবাসা প্রদর্শন আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
প্রবীণরা অনেক সময় সমাজের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাদের কাজ এবং অভিজ্ঞতাকে যথাযথ মূল্যায়ন করা উচিত। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রবীণ জীবনে স্বাস্থ্যের যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শারীরিক দুর্বলতা দেখা দেয়। এ কারণে তাদের জন্য সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা জরুরি। প্রবীণরা অনেক সময় একাকীত্বে ভোগেন। এই একাকীত্ব তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পরিবার ও সমাজের উচিত তাদের সাথে বেশি সময় কাটানো এবং তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা। অবসরের পর অনেক প্রবীণ ব্যক্তি অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তায় ভোগেন। তাদের জন্য একটি সুষ্ঠু পেনশন ব্যবস্থা বা আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
একটি পরিবারে প্রবীণ সদস্যদের উপস্থিতি সেই পরিবারকে সমৃদ্ধ করে। তারা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুন প্রজন্মকে পথ দেখান। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় রাখতে প্রবীণরা একটি সেতুবন্ধনের কাজ করেন। তবে বর্তমান সময়ে অনেক পরিবারে প্রবীণদের সঠিক সম্মান দেওয়া হয় না। বিশেষ করে যারা শহরে বসবাস করেন, সেখানে প্রবীণদের অনেক সময় একা ফেলে রাখা হয়। তাদের প্রতি উদাসীনতা দূর করা পরিবারগুলোর দায়িত্ব।
দেশের প্রবীণ নাগরিকদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। এ ধরনের নীতিমালার মাধ্যমে তাদের অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব।
সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা: প্রবীণদের চিকিৎসা সেবা সহজলভ্য করতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
বৃদ্ধাশ্রমের উন্নয়ন: বৃদ্ধাশ্রমগুলোর মানোন্নয়ন করা উচিত। এগুলো যেন কেবল একটি থাকার জায়গা না হয়ে বরং তাদের মানসিক ও শারীরিক চাহিদা পূরণের স্থান হয়।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি: প্রবীণদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর জন্য সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি।
তরুণ প্রজন্মের উচিত প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা প্রদর্শন করা। তাদের জীবনযাত্রা ও সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নেওয়া তরুণদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তরুণ প্রজন্মের উচিত—প্রবীণদের সময় দেওয়া। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া। তাদের প্রতি ধৈর্যশীল ও যত্নবান হওয়া।
প্রবীনদের যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় তাদের মধ্যে একাকীত্ব ও মানসিক অবসাদ। আর্থিক নিরাপত্তার অভাব।স্বাস্থ্য সমস্যার অবহেলা। পারিবারিক অবহেলা। প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে তাল মেলাতে না পারা।
রবীন্দ্র এ সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা আমাদের করণীয় হলো : প্রবীণদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ ও বিনোদনের ব্যবস্থা করা। তাদের আর্থিক সুরক্ষার জন্য সরকারি পেনশন বা ভাতা চালু করা। নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। পরিবার ও সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধি। প্রযুক্তি ব্যবহার শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
বর্তমান সমাজে প্রবীণদের প্রতি উদাসীনতা এবং অবহেলার প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম একদিকে কর্মব্যস্ত জীবনে মগ্ন, অন্যদিকে তারা ডিজিটাল দুনিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকে। ফলে পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের প্রতি সময় দেওয়া এবং তাদের প্রয়োজনগুলো বোঝার চেষ্টাও কমে যাচ্ছে।
অনেক পরিবারে প্রবীণদের শুধুমাত্র বোঝা হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশেষ করে আর্থিকভাবে নির্ভরশীল প্রবীণরা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে অযত্ন এবং অপমানজনক আচরণের শিকার হন। এই সামাজিক অবক্ষয় আমাদের পারিবারিক মূল্যবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। বৃদ্ধাশ্রমের ধারণা আমাদের সমাজে একসময় অচেনা ছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এটি এখন পরিচিত একটি বাস্তবতা। বৃদ্ধাশ্রম অনেক প্রবীণ ব্যক্তির জন্য শেষ আশ্রয়স্থল। কিন্তু এর নেপথ্যে যে কারণগুলো কাজ করে, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা দরকার। পরিবারের সাথে মতানৈক্য। সন্তানদের ব্যস্ত জীবনযাপন। আর্থিক অসচ্ছলতা। প্রবীণদের প্রতি উদাসীনতা।
বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে অনেক প্রবীণ ব্যক্তি ন্যূনতম যত্ন পেলেও সেখানে তাদের মানসিক চাহিদা মেটানো সম্ভব হয় না। তাদের একাকীত্ব, পরিবারের প্রতি হাহাকার এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা তাদের জীবনে হতাশা তৈরি করে।
তবে এটি বলা উচিত, সব বৃদ্ধাশ্রমের অভিজ্ঞতা খারাপ নয়। উন্নতমানের বৃদ্ধাশ্রমে প্রবীণদের আর্থিক ও মানসিক যত্ন নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের সমাজে বৃদ্ধাশ্রমের ভূমিকা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার।
প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তবে প্রবীণদের জন্য এটি অনেক সময় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। অনেক প্রবীণ ব্যক্তি প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়াতে পারেন না। ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন ব্যবহারের অজ্ঞতার কারণে তারা নিজেকে সমাজের বাইরে অনুভব করেন। তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগের দূরত্ব আরও বাড়ে।
প্রবীণদের প্রযুক্তিগত শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে তাদের এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। যেমন—স্মার্টফোন ব্যবহার শেখানো। ইন্টারনেটের সাহায্যে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করা। ডিজিটাল বিনোদনের সঙ্গে তাদের পরিচিত করা।
প্রবীণ ব্যক্তিরা অবসরের পরেও সমাজের জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। তাদের সৃজনশীলতা ও দক্ষতা বিভিন্ন সামাজিক কাজে লাগানো সম্ভব।
শিক্ষা: প্রবীণরা তরুণ প্রজন্মকে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা দিতে পারেন। যেমন, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা টিউশন বা কোচিং করতে পারেন।
সমাজসেবা: প্রবীণরা সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
হস্তশিল্প বা কৃষি: অনেক প্রবীণ ব্যক্তি তাদের দক্ষতা ব্যবহার করে সৃজনশীল কাজ করতে পারেন, যা তাদের মানসিক তৃপ্তি এনে দেবে।
বাংলাদেশসহ অনেক দেশে প্রবীণদের অধিকার সুরক্ষার জন্য আইন রয়েছে। তবে এই আইনগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় না। ্প্রবীণ নাগরিকদের সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। প্রবীণদের প্রতি নির্যাতন বা অবহেলার ক্ষেত্রে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবীণদের জন্য বিশেষ ভাতা এবং চিকিৎসা সুবিধা দেওয়া নিশ্চিত করতে হব।
বর্তমানে অনেক পরিবার পারিবারিক মূল্যবোধের পরিবর্তনের কারণে প্রবীণদের যথাযথ সম্মান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এটি শুধুমাত্র একটি ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক সংকট। পরিবারে প্রবীণদের মূল্যায়ন করতে হলে আমাদের কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত— ছোটবেলা থেকে সন্তানদের প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং যত্নের শিক্ষা দেওয়া।
পরিবারের প্রতিটি সিদ্ধান্তে প্রবীণদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। পারিবারিক মিলনমেলা ও অনুষ্ঠানে প্রবীণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রবীণদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। ইসলাম ধর্মে প্রবীণদের সেবা ও যত্ন নেওয়াকে অত্যন্ত মহৎ কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হিন্দু ধর্মে পিতা-মাতাকে দেবতুল্য মনে করা হয় এবং তাদের প্রতি সেবা প্রদানের গুরুত্ব দেওয়া হয়। বৌদ্ধ ও খ্রিস্ট ধর্মেও প্রবীণদের প্রতি যত্ন ও সহানুভূতি প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হয়েছে।
প্রবীণ জীবন আমাদের জন্য একদিন অনিবার্য সত্য হয়ে দাঁড়াবে। প্রবীণদের প্রতি আমাদের যে মনোভাব ও আচরণ, তা শুধু তাদের জন্য নয়, ভবিষ্যতে আমাদের নিজেদের জন্যও প্রাসঙ্গিক।
প্রবীণদের সঠিক যত্ন, মানসিক সমর্থন, আর্থিক নিরাপত্তা এবং সম্মান প্রদান সমাজের মানবিকতার পরিচায়ক। তাই আসুন, প্রবীণদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই এবং তাদের জন্য একটি সুন্দর, সম্মানজনক ও সুখী জীবন নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হই।
এই পৃথিবী আমাদের সবার, এবং প্রতিটি বয়সের মানুষই এখানে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রবীণদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশের মাধ্যমেই একটি নৈতিক ও মানবিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। প্রবীণ জীবন আমাদের সবার জীবনেরই একটি অবধারিত অংশ। আজ যারা প্রবীণ, একদিন তারাই ছিলেন তরুণ। তেমনি আজ যারা তরুণ, একদিন তারাই প্রবীণ হবে। তাই প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সহানুভূতিশীল হওয়া মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব। আমাদের উচিত, প্রবীণদের জীবনকে সুখী ও সম্মানজনক করে তোলার জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো।
প্রবীণদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলালে সমাজে সত্যিকার অর্থে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। তাদের জন্য ভালোবাসা ও যত্ন প্রদর্শনের মধ্য দিয়েই আমরা একটি সুন্দর ও সহমর্মী সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
লেখক পরিচিতি: উজ্জ্বল হোসাইন, লেখক ও প্রাবন্ধিক, চাঁদপুর।