বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর যুগে সাংবাদিকতার ভূমিকা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। তথ্য প্রবাহের সহজলভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মিস ইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশনের সমস্যা। সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে তৈরি ভুল তথ্যের মাধ্যমে সমাজের উপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়। এই প্রবন্ধে মিস ইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশনের সংজ্ঞা, প্রভাব, কারণ এবং এ থেকে উত্তরণের উপায় নিয়ে আলোচনা করা হবে।
মিস ইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশনের সংজ্ঞা
মিস ইনফরমেশন (Misinformation) : মিস ইনফরমেশন হলো ভুল বা অসত্য তথ্য যা অজান্তে ছড়ানো হয়। এর উদ্দেশ্য সাধারণত ক্ষতিকারক নয়। যেমন: কেউ কোনো ভুল খবর বা তথ্য শেয়ার করলে, কিন্তু তিনি জানেন না যে সেটি ভুল।
ডিসইনফরমেশন (Disinformation) : ডিসইনফরমেশন হলো ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানো। এটি সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে করা হয়, যেমন বিভ্রান্তি তৈরি করা, জনমত প্রভাবিত করা বা রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য।
সাংবাদিকতায় মিস ইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশনের ভূমিকা
১. তথ্য যাচাইয়ের অভাব : অনেক সময় সাংবাদিকরা তথ্য যাচাই না করেই সংবাদ প্রকাশ করেন। তথ্য যাচাইয়ের অভাবের ফলে মিস ইনফরমেশন ছড়িয়ে পড়ে।
২. ইচ্ছাকৃত মিথ্যাচার : ডিসইনফরমেশন অনেক সময় রাজনৈতিক বা আর্থিক লাভের জন্য করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনের আগে ভুয়া তথ্য প্রচার করে ভোটারদের বিভ্রান্ত করা।
৩. সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব : সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে দ্রুত গতিতে তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে মিথ্যা তথ্য সত্যের চেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখা যায়।
৪. ট্রলিং ও বট অ্যাকাউন্ট : বিভিন্ন ট্রল গ্রুপ ও বট অ্যাকাউন্ট ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
মিস ইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশনের প্রভাব
১. সামাজিক অস্থিরতা : ভুল তথ্য সমাজে বিভ্রান্তি ও উত্তেজনা তৈরি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর ছড়িয়ে সংঘর্ষ বাধানো।
২. রাজনৈতিক প্রভাব : ডিসইনফরমেশন রাজনৈতিক মতামত প্রভাবিত করতে ব্যবহৃত হয়। এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
৩. সাংবাদিকতার প্রতি বিশ্বাস কমানো : বারবার ভুল তথ্য প্রকাশিত হলে গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমে যায়।
৪. গুজবের প্রসার : মিস ইনফরমেশন থেকে গুজব সৃষ্টি হয়, যা ব্যবসা, স্বাস্থ্য, এবং ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
মিস ইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশনের কারণ
১. তথ্য যাচাইয়ের অভাব : অনেক সময় তাড়াহুড়ো করে সংবাদ প্রকাশের জন্য তথ্য যাচাই করা হয় না।
২. সাংবাদিকতার উপর চাপ : সাংবাদিকদের উপর খবর দ্রুত প্রকাশের চাপ থাকে, যা ভুল তথ্য ছড়ানোর সুযোগ করে দেয়।
৩. সোশ্যাল মিডিয়ার সহজলভ্যতা : সোশ্যাল মিডিয়ার সহজলভ্যতা তথ্য ছড়ানোর গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে ভুয়া খবর দ্রুত ভাইরাল হয়।
৪. অপর্যাপ্ত নীতিমালা : অনেক দেশে ভুয়া তথ্য প্রতিরোধে কার্যকর আইন বা নীতিমালা নেই।
৫. অজ্ঞতা ও অসচেতনতা : অনেক ব্যবহারকারী ভুল তথ্যের সত্যতা যাচাই না করেই তা শেয়ার করেন।
মিস ইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন প্রতিরোধে করণীয়
১. তথ্য যাচাইয়ের কৌশল শেখানো : সাংবাদিকদের তথ্য যাচাইয়ের টুলস ও কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।
২. সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ : সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে ফ্যাক্ট-চেকিং অপশন উন্নত করতে হবে।
৩. সচেতনতা বৃদ্ধি : সাধারণ মানুষের মধ্যে তথ্য যাচাইয়ের গুরুত্ব নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
৪. কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন : ভুয়া খবর ছড়ানোর জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
৫. ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন : ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করা দরকার।
উপসংহার : মিস ইনফরমেশন ও ডিসইনফরমেশন সাংবাদিকতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে গণমাধ্যম, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, এবং সাধারণ মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তথ্য যাচাইয়ের গুরুত্ব বোঝা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সাংবাদিকতার মৌলিক নীতিমালা বজায় রেখে সঠিক তথ্য প্রকাশের প্রতি গুরুত্ব দেওয়াই এ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধান।
লেখক : উজ্জ্বল হোসাইন, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স ২০২১, প্রেস ইনস্টিটিউট, ঢাকা।