গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। তথ্য সরবরাহ, জনমত গঠন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে গণমাধ্যমের এই শক্তির অপব্যবহার যখন শুরু হয়, তখন তা হয়ে ওঠে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’। বর্তমানে বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী হলুদ সাংবাদিকতার প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হলুদ সাংবাদিকতা বলতে এমন ধরনের সংবাদ পরিবেশনাকে বোঝায়, যেখানে সত্যের চেয়ে চাঞ্চল্য, গুজব, অর্ধসত্য, এবং অতিরঞ্জনের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়া হয়। এতে পাঠক বা দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়। তবে এর মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বিকৃত হয়। সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল, অনলাইন নিউজ পোর্টাল এমনকি সামাজিক মাধ্যমেও হলুদ সাংবাদিকতার বিস্তার লক্ষ্য করা যায়।
হলুদ সাংবাদিকতা অনেকগুলো বৈশিষ্ট আছে-অতিরঞ্জিত শিরোনাম, যাচাইবিহীন তথ্য, ব্যক্তিগত চরিত্রহনন, গুজব ও ভিত্তিহীন সংবাদের প্রচার, জনসচেতনতা বৃদ্ধির পরিবর্তে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা।
মূলকত হলুদ সাংবাদিকতার শুরু মূলত ১৯ শতকের শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। উইলিয়াম র্যান্ডলফ হার্স্ট এবং জোসেফ পুলিৎজারের মধ্যে সংবাদপত্র বিক্রির প্রতিযোগিতায় চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশের প্রবণতা দেখা দেয়। তখন “ইয়েলো কিড” নামে একটি কমিক চরিত্র জনপ্রিয় হওয়ায় ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ শব্দটির জন্ম হয়। ধীরে ধীরে এটি একটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। বর্তমান সময়ে, আধুনিক প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের বিকাশের সাথে সাথে হলুদ সাংবাদিকতার বিস্তার আরও দ্রুত হয়েছে।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের বিকাশ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে প্রিন্ট মিডিয়া ছাড়াও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং বর্তমানে অনলাইন মিডিয়া অনেক বিস্তৃত হয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার, দর্শক আকৃষ্ট করার চাপ এবং বিজ্ঞাপন আয়ের নির্ভরতাই মূলত হলুদ সাংবাদিকতার প্রসারে ভূমিকা রাখছে। কিছু সংবাদপত্র ও চ্যানেল সত্যাসত্য যাচাই না করেই চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রচার করে থাকে। যার ফলে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি জাতীয় নিরাপত্তাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
হলুদ সাংবাদিকতার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেমন-প্রতিযোগিতা এবং পাঠকসংখ্যা বাড়ানোর চাপ, বাজারে টিকে থাকার জন্য সংবাদমাধ্যমগুলো দ্রুততম এবং চিত্তাকর্ষক খবর প্রকাশের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্য-বিজ্ঞাপনদাতারা যেখানে বেশি দর্শক বা পাঠকসংখ্যা দেখেন, সেখানে বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেন। ফলে গণমাধ্যমগুলো দর্শকসংখ্যা বাড়াতে সংবাদের গুণগত মানের চেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয়বস্তুর উপর নির্ভর করে।
সাংবাদিকতার নৈতিকতার অভাব-অনেক সাংবাদিক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষা ছাড়াই পেশায় প্রবেশ করেন, যা হলুদ সাংবাদিকতার বিস্তার ঘটায়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-কিছু সংবাদমাধ্যম রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করে। তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার-সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তা মূলধারার মিডিয়াতেও স্থান পায়, ফলে হলুদ সাংবাদিকতা বাড়ে।
হলুদ সাংবাদিকতার নানামূখী প্রভাব রয়েছে-তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- জনমনে বিভ্রান্তি-ভিত্তিহীন এবং অতিরঞ্জিত সংবাদ জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, যা সামাজিক বিশৃঙ্খলা ডেকে আনতে পারে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সুনামহানি-মিথ্যা বা অপূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশের ফলে ব্যক্তিগত জীবনে এবং প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিতে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। গণমাধ্যমের উপর আস্থা কমে-বারবার হলুদ সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা জনগণকে গণমাধ্যমের প্রতি অবিশ্বাসী করে তোলে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষতি-প্রকৃত তথ্যের অভাবে নাগরিকরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে। সামাজিক অস্থিরতা-বিশেষ করে গুজব নির্ভর সংবাদ দ্রুত সামাজিক উত্তেজনা ও সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে।
হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধের আমাদেও অনেক করণীয় রয়েছে-যেমন নৈতিক সাংবাদিকতা চর্চা-সাংবাদিকদের উচিত নৈতিকতা ও পেশাদারিত্ব মেনে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করা। সঠিক তথ্য যাচাই না করে কোনো সংবাদ প্রকাশ করা উচিত নয়। সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা-গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং সাংবাদিকতার মৌলিক নীতিমালার শিক্ষা প্রয়োজন। গণমাধ্যমের স্বনিয়ন্ত্রণ-গণমাধ্যমগুলো নিজেরাই নিজেদের কার্যক্রমের জন্য দায়বদ্ধ থাকতে হবে। প্রেস কাউন্সিল বা সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আরো কার্যকরভাবে কাজ করতে পারে। আইনগত ব্যবস্থা-ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। তবে এতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিঘ্নিত না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি-পাঠক ও দর্শকদের সচেতন হতে হবে। যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো খবর বিশ্বাস করা উচিত নয়। মিডিয়া লিটারেসি শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তোলা জরুরি। সত্য-নির্ভর সাংবাদিকতার উৎসাহ-সংবাদের মান ও নির্ভরযোগ্যতার জন্য পুরস্কার ও স্বীকৃতি প্রদান করা হলে সাংবাদিকরা হলুদ সাংবাদিকতার পরিবর্তে গঠনমূলক সাংবাদিকতার দিকে আগ্রহী হবে। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ-
ফেক নিউজ বা গুজব রোধে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে এবং সরকারিভাবে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করতে হবে।
হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধে বাংলাদেশে ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে গণমাধ্যম নীতিমালা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে কিছুটা হলেও হলুদ সাংবাদিকতা প্রতিরোধের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি, কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করে সংবাদ যাচাইয়ের পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন যেমন প্রেস কাউন্সিল, সাংবাদিক ইউনিয়ন ইত্যাদি সংগঠন সংবাদ পরিবেশনায় নৈতিকতার প্রচারণা চালাচ্ছে।
গণমাধ্যম আধুনিক সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি শুধু সংবাদ পরিবেশন করে না, বরং জনমত গঠনে, গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে গণমাধ্যমের এই শক্তি তখনই ইতিবাচক হয় যখন এটি বস্তুনিষ্ঠতার সাথে পরিচালিত হয়। বস্তুনিষ্ঠতা মানে হলো সত্যতা, নিরপেক্ষতা এবং পক্ষপাতহীনভাবে তথ্য উপস্থাপন করা। গণমাধ্যম যদি বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে তা জনগণের কাছে ভুল বার্তা প্রেরণ করে এবং সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব হলো তথ্য সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাই করে তা যথাযথভাবে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সংবাদ পরিবেশনের সময় ব্যক্তিগত মতাদর্শ, রাজনৈতিক পক্ষপাত কিংবা বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রভাবিত না করতে পারাই হলো বস্তুনিষ্ঠতা। একজন সাংবাদিকের কর্তব্য হচ্ছে তথ্যের উৎস যাচাই করা, ভিন্নমতকে সম্মান দেখানো এবং ঘটনার সবদিক তুলে ধরা। পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ পরিবেশন সমাজে বিভাজন তৈরি করে, যা গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।
আজকের বিশ্বে ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট এবং অনলাইন মাধ্যমের বিপুল বিস্তারের কারণে সংবাদ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিযোগিতার এই যুগে কিছু গণমাধ্যম দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন বা অর্থনৈতিক লাভের জন্য অতিরঞ্জিত ও ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচার করে থাকে। এতে পাঠক বা দর্শকের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। গণমাধ্যমের উচিত — সংবাদের গতি নয়, গুণগত মানের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া। একটি স্বাধীন ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যমই পারে সঠিক তথ্য তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করতে।
গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন স্ব-নিয়ন্ত্রণ এবং নৈতিকতা। সাংবাদিকদের অবশ্যই তাদের পেশাগত নীতিমালা মেনে চলতে হবে। একই সাথে, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করতে হবে। বিজ্ঞাপনী স্বার্থ বা কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠীর চাপের কাছে নতি স্বীকার করা গণমাধ্যমের জন্য আত্মঘাতী। বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম জনগণের আস্থা অর্জন করে, আর এই আস্থাই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি।
তাছাড়া, সাধারণ জনগণেরও গণমাধ্যমের ওপর নজরদারি রাখা প্রয়োজন। ভোক্তাদের সচেতনতা গণমাধ্যমকে বস্তুনিষ্ঠ থাকার জন্য উৎসাহিত করে। আজকের যুগে সামাজিক মাধ্যমের বিস্তারে সাধারণ মানুষও সংবাদ প্রচারের অংশ হয়ে উঠেছে। তাই সংবাদ যাচাইয়ের প্রয়োজনীয়তা এখন আরও বেশি। মিথ্যা সংবাদ বা গুজবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে এবং সত্য-ভিত্তিক তথ্য ছড়িয়ে দিয়ে নাগরিকরাও গণমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখতে পারে।
সর্বশেষে বলা যায়, গণমাধ্যমের শক্তি তখনই প্রকৃত অর্থে সমাজের কল্যাণে আসে যখন সেটি বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখে। পক্ষপাতমুক্ত, ন্যায়সঙ্গত ও সত্যনিষ্ঠ গণমাধ্যমই পারে একটি সুস্থ, উন্নত ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তুলতে।
গণমাধ্যমের প্রকৃত শক্তি হলো সত্য এবং জনস্বার্থ রক্ষা। হলুদ সাংবাদিকতা সেই শক্তিকে দুর্বল করে জনগণের আস্থা বিনষ্ট করে। তাই গণমাধ্যমের উচিত সত্যের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকা এবং নৈতিকতার আদর্শ অনুসরণ করা। একইসঙ্গে পাঠক, দর্শক, সরকারি সংস্থা এবং নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব।
তথ্যভিত্তিক, নিরপেক্ষ এবং গঠনমূলক সাংবাদিকতাই পারে গণতন্ত্রকে মজবুত করতে এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে। সুতরাং, আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব হলুদ সাংবাদিকতার বিষয়ে সচেতন থাকা, এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া।
লেখক পরিচিতি : উজ্জ্বল হোসাইন, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স ব্যাচ ২০২১, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, ঢাকা।
সম্পাদক ও প্রকাশক : উজ্ব্বল হোসাইন
ভিজিট : www.dailyruposhibangla.com