জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই যেন একেকটি অমূল্য গল্প। তবে কিছু গল্পের স্বাদ অন্যরকম—অপরূপ, অতুলনীয়। এমনই এক অনন্য অভিজ্ঞতা হলো পিতৃত্ব। সেই প্রথমবার, যখন একজন পুরুষের মনে আসে একটি নতুন পরিচয়ের আনন্দ, দায়িত্ব এবং ভালোবাসা, তখন তার জীবন যেন নতুন এক রঙে রঞ্জিত হয়। আমি যখন প্রথম জানতে পারি, আমি বাবা হতে চলেছি, তখন মুহূর্তটি ছিল এক মিশ্র অনুভূতির। আনন্দ, উত্তেজনা, শঙ্কা—সবকিছু একসাথে। কোনো কিছুর সাথেই সেই অনুভূতিকে তুলনা করা যায় না। মনে হয়েছিল, যেন জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে, যেখানে প্রতিটি দিনই হবে শেখার, বোঝার, এবং অনুভব করার এক অসাধারণ সুযোগ।
যে মুহূর্তে জানতে পারলাম, আমার স্ত্রী মা হতে চলেছেন আর আমি বাবা হতে চলছি, আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অদ্ভুত আলোড়ন বয়ে গেল। আমার চারপাশটা কেমন যেন বদলে গেল। তখন মনে হচ্ছিল, আমি শুধু একজন মানুষ নই, একজন বাবা হতে চলেছি। আমার বুকে নতুন দায়িত্বের এক ভার যেন ধীরে ধীরে জমা হচ্ছিল। যে মানুষটা আগে নিজের প্রয়োজন আর আরামকেই বেশি গুরুত্ব দিত, সে হঠাৎ বুঝতে পারল, এখন থেকে আমার জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত আর ভাবনা আমার সন্তানকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে।
আমার স্ত্রীর গর্ভাবস্থায় নয়টি মাস ছিল অপেক্ষার এক দীর্ঘ উৎসব। প্রতিদিনই নতুন নতুন কিছু ঘটত। স্ত্রীর শারীরিক পরিবর্তন, তার চাহিদা, তার অনুভূতিগুলো আমার মনকে আরও গভীরভাবে সংবেদনশীল করে তুলেছিল। এই সময়টাতে আমার ভেতরে একটা অন্যরকম ভালোবাসার জন্ম নিল। হঠাৎ একদিন কালো অধ্যায় শুরু হলো-আমার স্ত্রী একটি ছোট্ট দূর্ঘটনায় বাম পায়ের হাঁটুর নিচে প্রধান যে দুটি হাড় টিবিও-ফিবুলা মাঝ বরাবর ভেঙ্গে যায়। আমি সকালের নাস্তা সেরে অন্য দিনের মতো রেডি হয়ে অফিসে চলে যাই। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হই মনে মধ্যে একটা
প্রতিদিনই মনে হতো, আমার সন্তানটি কেমন হবে? তার চেহারা কেমন হবে? সে কি আমার মতো হবে, নাকি তার মায়ের মতো? এই কল্পনাগুলো আমাকে এক অদ্ভুত আনন্দ দিত। আর এই অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে শিখিয়েছিল ধৈর্য আর ত্যাগের মানে।-++++
যে দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে, সেটি হলো আমার সন্তানের জন্মদিন। সেই প্রথমবার, ১৩ জুন ২০১৩ শান্ত এক বিকেলে যখন তার কান্নার শব্দ শুনলাম, আমার মনে হলো যেন পুরো পৃথিবী আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে আমার হাতে প্রথমবার ধরে মনে হয়েছিল, আমি একটি স্বর্গীয় অনুভূতির অংশীদার। তাকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল, এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার। ছোট্ট একটি প্রাণ, যার মুখে নিষ্পাপ একটি হাসি, সেই মুহূর্তেই আমার জীবনের সকল কষ্ট, সব ক্লান্তি হারিয়ে গিয়েছিল। পিতৃত্ব মানেই শুধু আনন্দ নয়, এটি একটি বিশাল দায়িত্ব। সন্তানের প্রতি যত্ন নেওয়া, তাকে সঠিক পথে চালিত করা, তার জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা—এসব কিছুই আমার কাছে ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।
প্রথমবার, যখন রাতে সন্তানকে ঘুম পাড়াতে পারিনি, তখন বুঝেছিলাম, বাবা হওয়া কতটা কঠিন। একটি ছোট শিশুর চাহিদা, তার কান্না, তার আনন্দ, সবকিছু বুঝতে শিখতে হয়। কিন্তু সেই কঠিন মুহূর্তগুলোও আমার জন্য এক নতুন শিক্ষার দরজা খুলে দিয়েছিল। আমার সন্তান আমাকে জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শিখিয়েছে। ধৈর্য ধরার শিক্ষা, ত্যাগের মানে বোঝা, আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার আসল অনুভূতি—এগুলো সবই আমি শিখেছি আমার সন্তান থেকে।
আমি অনুভব করেছি, বাবা হওয়া মানে শুধুই একজন অভিভাবক হওয়া নয়। এটি মানে, একজন পথপ্রদর্শক, একজন রক্ষক, এবং একজন সঙ্গী হওয়া। আমার সন্তান আমাকে নতুনভাবে জীবনকে দেখতে শিখিয়েছে। পিতৃত্বের সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। সন্তানের প্রতি ভালোবাসার কোনো শর্ত থাকে না, কোনো সীমা থাকে না। তার হাসি, তার ছোট ছোট কাণ্ডকারখানা, তার প্রথম শব্দ—বা-বা, মা এসবই জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ এনে দেয়। আমি বুঝেছি, পিতৃত্ব মানে নিজের সুখকে পেছনে রেখে সন্তানের সুখকে সামনে রাখা। তার জন্য কিছু করতে পারা মানেই জীবনের আসল তৃপ্তি।
সন্তানের আগমন শুধু আমার জীবনেই নয়, পুরো পরিবারকেই বদলে দিয়েছিল। আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্য যেন আরও কাছাকাছি এসে গেল। সন্তানের জন্য আমরা সবাই একসাথে কাজ করতাম, একে অপরের প্রতি আরও যত্নশীল হয়ে উঠেছিলাম। সন্তানের মাধ্যমে আমি বুঝতে পেরেছি, একটি পরিবার কীভাবে একসঙ্গে এগিয়ে যায়। পরিবার মানে কেবল রক্তের বন্ধন নয়, এটি ভালোবাসা, ত্যাগ, এবং একে অপরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস।
পিতৃত্ব একটি অনন্ত যাত্রা, যা প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। প্রতিদিনই নতুন কিছু শেখার থাকে, নতুন কিছু অনুভব করার থাকে। আমার সন্তানের বড় হওয়া, তার বেড়ে ওঠা, তার জীবনের প্রতিটি ছোট ছোট সাফল্য আমাকে গর্বিত করে।
আমি জানি, সামনে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে। কিন্তু আমি সেই চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত। কারণ আমি জানি, আমার সন্তানের হাসির জন্য, তার সুখের জন্য আমি যে কোনো কিছু করতে পারি।
পিতৃত্বের স্বাদ এমন এক অভিজ্ঞতা, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এটি এমন এক অনুভূতি, যা প্রথমবার অনুভব করার পর জীবনের সমস্ত কিছু বদলে যায়। সন্তান জন্মের আগে পর্যন্ত হয়তো নিজের জীবনকেই কেন্দ্র করে সবকিছু আবর্তিত হয়। কিন্তু বাবা হওয়ার পর, জীবন যেন অন্যরকম এক অর্থ পায়।
পিতৃত্ব আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। প্রথমেই শিখিয়েছে ধৈর্য। সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি মুহূর্তেই ধৈর্যের প্রয়োজন। তার কান্না, খাওয়া, আরাম—সবকিছুতে আমাকে ধৈর্য ধরে তার চাহিদাগুলো বুঝতে হয়েছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। বাবা হওয়ার পর বুঝেছি, সন্তানের জন্য ত্যাগ করতে কখনোই কষ্ট হয় না। তার সুখই আমার সুখ, তার স্বস্তিই আমার স্বস্তি।
পিতৃত্বের প্রথম স্বাদ আমাকে জীবনের নতুন মানে বুঝিয়েছে। এটি কেবল একটি অনুভূতি নয়, এটি একটি যাত্রা, যা কখনো শেষ হয় না। এই যাত্রা আমাকে আরও ভালো মানুষ হতে সাহায্য করেছে। আমার সন্তান আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। তার জন্য আমি আরও শক্তিশালী, আরও দায়িত্বশীল এবং আরও ভালো বাবা হতে চাই। পিতৃত্বের এই মধুর অভিজ্ঞতা আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অধ্যায়, যা আমি সারা জীবন মনে রাখব।
লেখক পরিচিতি: উজ্জ্বল হোসাইন, লেখক ও প্রাবন্ধিক, চাঁদপুর।
সম্পাদক ও প্রকাশক : উজ্ব্বল হোসাইন
ভিজিট : www.dailyruposhibangla.com