খুঁজুন
                               
শুক্রবার, ১৬ মে, ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২

উপদেষ্টা মাহফুজের মাথায় বোতল নিক্ষেপকারী সম্পর্কে যা জানা গেল

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫, ১:১৭ অপরাহ্ণ
উপদেষ্টা মাহফুজের মাথায় বোতল নিক্ষেপকারী সম্পর্কে যা জানা গেল

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। এ সময় তাকে লক্ষ্য করে পানির বোতল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বুধবার (১৪ মে) রাত ১০টার দিকে পুলিশি ব্যারিকেডের সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। এমন সময় তাকে লক্ষ্য করে একটি পানির বোতল নিক্ষেপ করা হলে সেটি গিয়ে উপদেষ্টার মাথায় লাগে। জানা যায়, বোতল নিক্ষেপকারীর পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা না গেলেও পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গ্রুপে ভিডিও দেখে তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বোতল নিক্ষেপকারী ওই যুবকের নাম ইশতিয়াক হোসেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ১৯তম ব্যাচের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি।

এদিকে বোতল নিক্ষেপের ঘটনার পর রাতেই ওই শিক্ষার্থীর পরিচয়ের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট দিতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ‘জবিয়ান্স’ নামের একটি পেজের পোস্টে উল্লেখ করা হয়, বোতল নিক্ষেপকারীর নাম ইশতিয়াক হোসাইন। ডিপার্টমেন্ট অর্থনীতি, ব্যাচ ১৯। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মো. তাজাম্মুল বলেন, ‘ওই শিক্ষার্থী অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের। আমাদের এখন মূল কাজ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিদাওয়া আদায়। ওই শিক্ষার্থীর এসব বিষয়ে এখন মাথা ঘামানোর সময় নেই।’ আমাদের দাবি আদায় হলে পরিস্থিতি অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী নির্বাচন বানচাল ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সর্বস্তরে লেখকদের মানববন্ধন

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫, ৩:৩৩ অপরাহ্ণ
চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী নির্বাচন বানচাল ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সর্বস্তরে লেখকদের মানববন্ধন

চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী নির্বাচনকে বানচাল, অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছে চাঁদপুর জেলার সর্বস্তরে লেখক সমাজ।  বৃহস্পতিবার (১৫ মে ২০২৫) বেলা ১২টায় শহরের জোড় পুকুরপাড়স্থ চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর সামনে এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কবি ও প্রাবন্ধিক আবদুল্লাহিল কাফী, চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমির সাবেক নির্বাহী সদস্য প্রবীণ লেখক এবং চাঁদপুর জেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি মাহবুব আনোয়ার বাবলু, সাহিত্য একাডেমীর এডহক কমিটির সদস্য, চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং কবি গল্পকার ও প্রাবন্ধিক কাদের পলাশ, চাঁদপুর সাহিত্য মঞ্চের সাবেক সভাপতি কবি ও অনুবাদক মাইনুল ইসলাম মানিক, চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমী সাধারণ সদস্য কবি ও গল্পকার নুরুন্নাহার মুন্নি, সাহিত্য একাডেমীর নির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য কবি ও সম্পাদক ম. নূরের আলম পাটোয়ার‌, চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর সাধারণ সদস্য এবং জেলা গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক কবি আশরাফুজ্জামান কাজী রাসেল, চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর সাবেক অডহক কমিটির সদস্য এবং চাঁদপুর সাহিত্য মঞ্চের সভাপতি কবি আশিক বিন রহিম, সাহিত্য একাডেমীর সাধারণ সদস্য কবি ও গীতিকার কবির হোসেন মিজি।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমির সাধারণ সদস্য মুখলেসুর রহমান ভূঁইয়া, সুমন কুমার দত্ত, পলাশ দে, আতিকুর রহমান রুবেল, আরিফুল ইসলাম শান্ত, এএম সাদ্দাম হোসেন, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী নূরে আলম, লেখক ও সাংবাদিক বিল্লাল ঢালী, এইচএম নিজাম প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, দীর্ঘদিন পর চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমীর সাধারণ সভা হতে যাচ্ছে.। এই সভায় সাধারণ সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে সাহিত্য একাডেমীর নিয়মিত কমিটি গঠন করা হবে। সাহিত্য একাডেমি নির্বাচনকে ঘিরে চাঁদপুর লেখকদের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনা বিরাজ করছে। অথচ দুই একজন ব্যক্তি চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমির দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার করছে। তারা জেলা প্রশাসনের এই সুন্দর প্রয়াসকে বানচাল করতে উঠে পড়ে লেগেছে।

বক্তারা আরো বলেন, মূলত তাদের ক্ষোভ হলো সাহিত্য একাডেমী সদস্য হতে না পারা। গত এক বছর পূর্বে চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্থানীয় সকল পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাহিত্য একাডেমীর সদস্য আহবান করা হয়। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে এক লেখক অপর লেখকের সাথে যোগাযোগ করেন। ‌পরবর্তীতে জেলা প্রশাসন সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিক সদস্য থেকে যাচাই-বাছাই করে প্রাথমিক সদস্য পরে সাধারণ সদস্য করেন। পাশাপাশি যারা অলেখক তাদেরকে সদস্য থেকে বাতিল করেন।
পরবর্তীতে সাহিত্য একাডেমীর ইতিহাস এই প্রথমবারের মতো সাধারণ সভার আহবান করে প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্মিত কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেন জেলা প্রশাসন। এখন যারা সাহিত্য একাডেমির নির্বাচন নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা কেউ তখন সদস্য হওয়ার জন্য আগ্রহ দেখায়নি। এখন নির্বাচনের উৎসব দেখে গাত্রদাহ থেকে তারা মূলত এই অপপ্রচার চালাচ্ছে।

মানববন্ধন থেকে লেখকরা দীর্ঘদিন পর সাহিত্য একাডেমী সাধারণ সভা এবং নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের আয়োজন করায় জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ জানান।

জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতায় আমাদের করণীয়

উজ্জ্বল হোসাইন
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫, ১২:৩৫ অপরাহ্ণ
জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতায় আমাদের করণীয়

গণমাধ্যম সমাজের দর্পণ। এটি যেমন জনমত গঠনে ভূমিকা রাখে, তেমনি সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতিকেও প্রভাবিত করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো বৈচিত্র্য, সাম্য ও মানবাধিকারের প্রশ্নে সত্যনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ ও সংবেদনশীল প্রতিবেদন প্রকাশ করা। জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতা এই বৃহত্তর নৈতিক ও পেশাগত দায়িত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। বর্তমানে নারী, তৃতীয় লিঙ্গ এবং অন্যান্য লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষ সমাজে নানা ধরনের বৈষম্য, নির্যাতন ও বঞ্চনার শিকার হন। সাংবাদিকতা যখন এই বৈষম্যগুলোকে তুলে ধরার পরিবর্তে তা আরও তীব্র করে তোলে, তখন সেটি সমস্যার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে, সাংবাদিকতা যদি জেন্ডার সংবেদনশীল হয়, তবে সেটি সমাজ পরিবর্তনের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতা হলো এমন একটি পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে সংবাদ সংগ্রহ, লেখা, উপস্থাপন এবং বিশ্লেষণের প্রতিটি পর্যায়ে লিঙ্গ বৈচিত্র্য, সমতা ও মর্যাদার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়। এটি কেবল পুরুষ-নারী বিভাজনের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সকল লিঙ্গ পরিচয় ও অভিজ্ঞতাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই ধরনের সাংবাদিকতা সমাজে প্রচলিত লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, সহিংসতা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে চায়। জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতা তথ্য উপস্থাপন করে এমনভাবে, যা কাউকে অপমান করে না, লিঙ্গ পরিচয়কে হাস্যরসের বিষয় করে তোলে না, এবং যা নারীর কিংবা অন্যান্য লিঙ্গ পরিচয়ের ব্যক্তির প্রতি অবমাননাকর ভাষা বা দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে না।
বাংলাদেশসহ অনেক দেশে গণমাধ্যমে জেন্ডার সংবেদনশীলতা এখনো পুরোপুরি গৃহীত হয়নি। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টাল এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও আমরা প্রায়ই দেখি। ভিকটিম-ব্লেমিং-ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার ঘটনার বর্ণনায় অনেক সময় ভুক্তভোগীকেই দোষারোপ করা হয়। তার পোশাক, চলাফেরা বা নিয়ম না মানার বিষয় তুলে ধরা হয়। ক্লিকবেইট শিরোনাম ও যৌন উত্তেজক উপস্থাপনা। নারীর শরীর বা যৌনতা নিয়ে চটকদার শিরোনাম, ছবি বা ভিডিও ব্যবহার করা হয় যা মূল বিষয় থেকে পাঠক/দর্শককে অন্যদিকে আকর্ষণ করে। তৃতীয় লিঙ্গ/হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করা হয়। এখনও অনেক সংবাদমাধ্যমে উভলিঙ্গ, হিজড়া সমস্যা বা পুরুষ-না-নারী-না ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয় যা গভীরভাবে অসম্মানজনক। নারীর সফলতাকে পারিবারিক অবদানের মাধ্যমে খাটো করা হচ্ছে। একজন নারী যখন কোনো ক্ষেত্রে সফল হন তখন সেটিকে তাঁর স্বামী বা পরিবারের সহযোগিতার ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।
তাই জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতা বাস্তবায়নে আমাদের বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিতে হবে। সাংবাদিকদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সংবাদ কর্মীদের জেন্ডার বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। কীভাবে লিঙ্গ বৈষম্য ঘটে কোন শব্দগুলো অবমাননাকর বা স্টেরিওটাইপ তৈরি করে এসব বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা দরকার। জেন্ডার-বিষয়ক নীতিমালা মেনে চলার জন্য নিউজরুমে একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকা উচিত। আমাদের ভাষা ও উপস্থাপনা সচেতন হতে হবে। সংবাদে কোন শব্দ ব্যবহারে নারীর প্রতি অবমাননা হবে সেটি ত্যাগ করতে হবে। সংবাদ পরিবেশনে লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ভাষা ব্যবহার করা উচিত। যেমন-অভিযুক্ত ব্যক্তি বলা যেতে পারে ধর্ষক, ধর্ষিতার ছবি প্রকাশ না করা যেতে পারে। আমরা প্রায়ই সময় দেখি দোষী প্রমাণিত না হওয়ার আগেই ধর্ষক, হত্যাকারী, মাদক ব্যবসায়ী, পতিতা, চোর, ডাকাত ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়। এসব শব্দ দোষী প্রমাণ সাপেক্ষে উপস্থাপন করা যেতে পারে।
আবার অন্য দিকে নারী চিকিৎসক বা মহিলা ইঞ্জিনিয়ার বলার পরিবর্তে শুধু চিকিৎসক বা ইঞ্জিনিয়ার বলে সংবাদে উপস্থাপন করলে উহা শ্রুতিমধুর ও যথার্থতা প্রকাশ প্রায়। লিঙ্গ বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদমাধ্যমে নারী, তৃতীয় লিঙ্গ, লিঙ্গ-বিচারভিত্তিক সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দিতে হবে। টক শো, সাক্ষাৎকার, প্যানেল আলোচনায় শুধু পুরুষদের না এনে নারী ও অন্যান্য লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষদেরও সমান সুযোগ দিতে হবে। প্রসঙ্গভিত্তিক গভীরতর বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে হবে। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি বা বৈষম্যের ঘটনাগুলো কেবল ঘটনাভিত্তিক না করে তার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আইনি প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে পরিবেশন করতে হবে। নারী ও লিঙ্গ সংখ্যালঘুদের সাফল্য, সংগ্রাম ও অবদান নিয়েও নিয়মিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। যে কোনো মিডিয়ায় সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।
অনেক সময় সাংবাদিক সঠিক রিপোর্ট তৈরি করলেও সম্পাদকীয় পর্যায়ে সেটি পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাই সম্পাদকদেরও এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও সংবেদনশীল হতে হবে। সাংবাদিকদের লেখা রিপোর্টে কেউ যদি জেন্ডারবিরোধী উপাদান টেনে আনেন, সেটি যেন সম্পাদনা করে অপসারণ করা হয়। নৈতিকতা ও মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে কাজ করতে হবে। সাংবাদিকদের উচিত ‘ডু নো হার্ম’ নীতিতে বিশ্বাস রাখা। কোনো সংবাদের ফলে যেন ভুক্তভোগীর দ্বিতীয়বার ক্ষতি না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সবার মর্যাদা ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য সাংবাদিকদের প্রতিটি শব্দ, ছবি ও ব্যাখ্যার প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে।

যে কোনো ঘটনা বিশ্লেষনে ইতিবাচক হতে হবে। তবে আশার আলো হলো-বাংলাদেশের কিছু সংবাদমাধ্যম ইতোমধ্যে জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতার দিকে ধাবিত হয়েছে। যেমন : প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্র (ইঘঔঈ) জেন্ডার সচেতনতা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। কিছু অনলাইন পোর্টাল নারী নেতৃত্ব, কর্মজীবী নারীর সংগ্রাম উদ্যোক্তাদের জীবন-জীবিকা ও তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। তৃতীয় লিঙ্গ শব্দ না লিখে হিজড়া, মহিলা শব্দ না লিখে নারী শব্দে বদলে ফেলা হয়েছে অনেক পত্রিকায়।
একজন সাংবাদিক কেবল তথ্য পরিবেশনের কাজ করেন না; তিনি সমাজ গঠনেরও অংশ। একজন সত্যনিষ্ঠ ও সংবেদনশীল সাংবাদিক সমাজে ইতিবাচক আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেন। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে এবং নীতিনির্ধারণে সাংবাদিকতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জেন্ডার সংবেদনশীল সাংবাদিকতা কেবল একটি নৈতিক দাবি নয়, এটি মানবিকতার এবং পেশাগত দায়িত্বের অংশ। সাংবাদিকদের উচিত লিঙ্গ বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, সংবেদনশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা। এর মাধ্যমে গণমাধ্যম সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবে এবং একটি অধিকতর ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে অবদান রাখতে পারবে।
লেখক পরিচিতি : উজ্জ্বল হোসাইন, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স (ব্যাচ-২০২১), প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ।

সাহিত্য-সংস্কৃতি এক ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধন

উজ্জ্বল হোসাইন
প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫, ১১:৫৯ পূর্বাহ্ণ
সাহিত্য-সংস্কৃতি এক ও অবিচ্ছেদ্য বন্ধন

মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতি মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এই দুইয়ের সম্পর্ক এতটাই নিবিড় ও আন্তঃসম্পর্কিত যে, একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করাই কঠিন। সাহিত্য একটি সমাজের চিন্তা, চেতনা, অনুভব ও কল্পনার রূপান্তর যেখানে সংস্কৃতি হল সেই সমাজের জীবনধারা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও অভ্যাসের প্রতিফলন। এই প্রবন্ধে আমরা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, একে অপরকে প্রভাবিত করার রূপ, এবং সমাজে এদের অবদান বিশ্লেষণ করব।
সাহিত্য শব্দের অর্থ ‘সাহিত্যের সৃষ্টি’ যা ভাষার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। সাহিত্য কেবল কল্পনার ফসল নয়, এটি বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবিও বটে। সাহিত্য সমাজের দর্পণ। যা সময়ের পরিবর্তন, মানুষের ভাবনা, ইতিহাস ও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে।
সংস্কৃতি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতু থেকে, যার অর্থ ‘গঠন করা’, ‘পরিশোধন করা’। সমাজবদ্ধ মানুষের জীবনযাপনের ধারা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, আচার-অনুষ্ঠান, ভাষা, শিল্পকলা সব মিলিয়েই গঠিত হয় সংস্কৃতি। এটি সময়ের সঙ্গে রূপান্তরিত হলেও এর শিকড় থাকে অতীত অভিজ্ঞতায়।
সাহিত্য সংস্কৃতির অনুবাদক। সাহিত্য সংস্কৃতিকে চিত্রিত করে, বিশ্লেষণ করে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তা সঞ্চারিত করে। অন্যদিকে, সংস্কৃতি সাহিত্যের রসদ জোগায় তার বিষয়বস্তু, পটভূমি ও চরিত্রের মাধ্যমে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি একে অপরকে পুষ্ট করে।
যেকোনো কালে রচিত সাহিত্য সেই সময়ের সংস্কৃতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট ও জীবনের প্রতিফলন। যেমন মঙ্গলকাব্য বাংলার লোকজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে। এতে কৃষি নির্ভর সমাজের দেব-দেবী পূজার আচার, মানুষের বিশ্বাস ইত্যাদি প্রতিফলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য আধুনিক বাঙালি মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর গান, কবিতা, উপন্যাসে সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক রূপ ফুটে উঠেছে। সাহিত্য রচনায় লেখক তার চারপাশের সংস্কৃতি থেকে উপাদান গ্রহণ করেন জীবনধারা, ভাষা, প্রবাদ-প্রবচন, লোক কাহিনি, পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি। এই উপাদানগুলো সাহিত্যকে সময়-প্রাসঙ্গিক করে তোলে।
সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ভাষা সাহিত্যের বাহক। ভিন্ন অঞ্চলের সাহিত্য তাদের স্বতন্ত্র ভাষা ও উপভাষার মাধ্যমেই এক ভিন্ন সাংস্কৃতিক রঙ বহন করে। যেমন বাংলাদেশের রংপুর অঞ্চলের সাহিত্য ঢাকার সাহিত্যের চেয়ে ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে আলাদা।
ইতিহাসের ধারায় সাহিত্য-সংস্কৃতি-সাহিত্য ও সংস্কৃতি কালের স্রোতে কিভাবে একে অপরকে প্রভাবিত করেছে, তা ইতিহাসের পাতা ও সাহিত্যচর্চায় স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। পৌরাণিক কাহিনি, বেদ, মহাভারত ও রামায়ণ শুধু ধর্মীয় নয়, সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। এসব গ্রন্থ ভারতীয় সংস্কৃতির শিকড় গেঁথে দিয়েছে। ভক্তি কাব্যধারার (চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, মীরাবাঈ) সাহিত্য সমাজে একটি ভিন্ন সাংস্কৃতিক চেতনার সঞ্চার করেছে। ইসলামী রেনেসাঁ ও সুফি সাহিত্যে নতুন ধ্যান-ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে। বঙ্গ জবহধরংংধহপব-এর সময় সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবজাগরণ ঘটে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইত্যাদি ব্যক্তিত্ব সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে নতুন সমাজচিন্তা ও সংস্কৃতির জন্ম দেন।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মানিক, সঞ্জীব, জীবনানন্দ, সুনীল, শঙ্খ ঘোষ থেকে শুরু করে হুমায়ুন আহমেদ ও সমকালীন লেখকগণ তাঁদের সাহিত্যে সমকালীন সংস্কৃতির বিবর্তন তুলে ধরেছেন। গ্লোবালাইজেশনের প্রভাবে সাহিত্যেও পরিবর্তন এসেছে—নতুন বিষয়, প্রযুক্তি, নগর-জীবনের টানাপোড়েন উঠে এসেছে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি কেবল শিল্প বা রুচির বিষয় নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনেরও হাতিয়ার। এরা মানুষের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক চেতনা গঠনে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহিত্যে দেশপ্রেম, সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরে জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির বিকাশ ঘটায়। সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ লেখকের সাহিত্য জনগণের চেতনাকে উজ্জীবিত করে।
সাহিত্যে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের চিত্রায়নের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারে ভূমিকা রাখে। বিশ্বসাহিত্যে টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি কিংবা মার্কেজের রচনাগুলি মানবিক সংস্কৃতিকে উন্মোচন করে। একটি জাতির সাহিত্য তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করে, অন্যদিকে সংস্কৃতি তাকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করে। সাহিত্য সংস্কৃতির ভাষ্যকার হিসেবে কাজ করে, যা একটি জাতিকে তার ঐতিহ্য, ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সঙ্গে যুক্ত রাখে।
আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সম্পর্ক নতুনভাবে ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ডিজিটাল যুগে সাহিত্য, ই-বুক, অডিওবুক, ব্লগ, সোস্যাল মিডিয়ায় সাহিত্য এখন সহজলভ্য। যদিও এই মাধ্যম সাহিত্যকে গণমুখী করছে, তবুও দ্রুততার যুগে গভীর পাঠের অভ্যাস হারিয়ে যাচ্ছে, যা সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার জন্য হুমকি।
বিশ্বায়নের ফলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আধিপত্য বাড়ছে, যার প্রভাবে স্থানীয় ভাষা, পোশাক, খাদ্য, রীতিনীতি প্রভৃতি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সাহিত্য এ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে আত্মপরিচয়ের রক্ষাকবচ হতে পারে। স্থানীয় সাহিত্যচর্চার প্রসার অঞ্চলভিত্তিক সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির সংরক্ষণ ও প্রসারে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ভাষার বিকাশে সাহিত্যচর্চা-সাহিত্যই ভাষাকে জীবিত রাখে। তাই মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনা ও পাঠ উৎসাহিত করতে হবে।
নতুন মাধ্যমের সদ্ব্যবহার করতে হবে। ডিজিটাল মাধ্যমে সাহিত্যকে ছড়িয়ে দিতে হবে। সাহিত্য ফেস্টিভ্যাল, অনলাইন ম্যাগাজিন, অডিওভিত্তিক সাহিত্যচর্চা আরও জনপ্রিয় করা যেতে পারে। ব্যাপক পরিসরে সাংস্কৃতিক সংলাপ করা যেতে পারে। ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সাহিত্য যেমন সমৃদ্ধ হয়, তেমনি বহুত্ববাদী সমাজে সহাবস্থানের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে সাহিত্য ও সংস্কৃতি কেবল সময়ের সঙ্গে বদলায়নি বরং নতুন বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে অভিযোজিত করেছে। এই অভিযোজন কখনো ভাষার রূপে, কখনো গল্প বলার ধরনে, কখনও কখনো সময়ের ব্যবধানে, কখনো বা বিষয়ের বিন্যাসে প্রকাশ পেয়েছে। লোকসাহিত্য ছিলো মৌখিক সংস্কৃতির বাহক পল্লিগাথা, পালাগান, লোক কবিতা ইত্যাদিতে আমরা সংস্কৃতির জীবন্ত চিত্র পাই। যেমন-ভাটিয়ালি গান নদীমাতৃক বাংলার সংস্কৃতি ও পেশাজীবনের প্রতিচ্ছবি। পরবর্তীকালে এই মৌখিক ধারা লিখিত সাহিত্যে রূপান্তরিত হয়ে আধুনিক পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমৃদ্ধ করেছে। আধুনিক সাহিত্যে শহর-গ্রামের দ্বন্দ্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। একদিকে গ্রামীণ সংস্কৃতির বিলুপ্তির ভয়, অন্যদিকে শহুরে জীবনযাত্রার জটিলতা—এই দুই বিপরীত সংস্কৃতি সাহিত্যে এক নতুন ধরনের দ্বন্দ্ব ও উপলব্ধি সৃষ্টি করেছে। যেমন-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসে নদীকেন্দ্রিক সংস্কৃতি, সামাজিক সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সংগ্রাম অসাধারণভাবে চিত্রিত হয়েছে। আবার সমরেশ মজুমদার বা সেলিনা হোসেনের রচনায় শহর-গ্রামের পারস্পরিক টানা-পোড়েন পাওয়া যায়। সাহিত্য ও সংস্কৃতির সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে নারীর অবস্থান ও তাঁর অভিজ্ঞতা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। নারীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাহিত্যচর্চা এক ভিন্ন সাংস্কৃতিক বোধ তৈরি করে। মহাশ্বেতা দেবীর লেখায় আদিবাসী নারী ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক সংগ্রাম উঠে এসেছে। তসলিমা নাসরিন বা সেলিনা হোসেনের সাহিত্যে নারীর আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম একটি সাহসী সংস্কৃতির উদাহরণ।
নারী যখন সাহিত্যচর্চায় সক্রিয় হন, তখন তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও জীবনযাপন একটি নতুন সাংস্কৃতিক পরিসর সৃষ্টি করে। বর্তমান সময়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রযুক্তির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি ইত্যাদি নতুন মাধ্যমগুলো সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছে। আজকাল অনেকে ইনস্টাগ্রামে পোয়েট্রি ব্লগিং করছেন, যেখানে মেট্রোপলিটন জীবনের অনুভূতি, প্রেম, বিচ্ছেদ—সবই ছন্দবদ্ধভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। অনেক সাহিত্যিক ডিজিটাল নাটক বা স্ক্রিনপ্লের মাধ্যমে সমকালীন সংস্কৃতির টানাপোড়েন ফুটিয়ে তুলছেন। এটি প্রমাণ করে, সাহিত্যের রূপ বদলালেও তার মূল কাজ সংস্কৃতির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যেও সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ঙহব ঐঁহফৎবফ ণবধৎং ড়ভ ঝড়ষরঃঁফব উপন্যাসে লাতিন আমেরিকার ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতি মিশে গিয়ে সাহিত্যকে মহাকাব্যে পরিণত করেছে। চিনুয়া আচেবের ঞযরহমং ঋধষষ অঢ়ধৎঃ আফ্রিকান সমাজ ও ঔপনিবেশিক সাংস্কৃতিক সংঘাতকে চিত্রিত করেছে। হারুকি মুরাকামি তাঁর জাপানি সামাজিক বাস্তবতা ও সংস্কৃতি এক বিমূর্ত ও আধুনিক রূপে উপস্থাপন করেন। এসব সাহিত্যকর্ম প্রমাণ করে যে, সাহিত্য বিভিন্ন জাতির সাংস্কৃতিক স্মৃতি ধারণ করে রাখে এবং বিশ্বকে সেই জাতির অন্তর্জগতের সঙ্গে পরিচিত করায়। বয়সভিত্তিক শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চায় সংস্কৃতির বীজ রোপণ করা জরুরি।
শিশু-কিশোর সাহিত্য তাদের ভেতরে নৈতিকতা, সহানুভূতি ও সাংস্কৃতিক পরিচয় গঠনে সাহায্য করে। গল্পের মাধ্যমে শিশুরা দেশের ইতিহাস, লোক কাহিনি, মহান ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে জানতে পারে। নাটক, কবিতা আবৃত্তি, বইপড়া প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে তারা সাহিত্যিক রুচি ও সাংস্কৃতিক পরিশীলন লাভ করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে নিজের শেকড় ভুলে না যায়, তার জন্য স্কুল-কলেজে সাহিত্য ও সংস্কৃতির কার্যকর মেলবন্ধন অপরিহার্য।
সাহিত্য ও সংস্কৃতিএই দুই একে অপরের অবিচ্ছেদ্য আত্মা ও শরীর। সাহিত্য সংস্কৃতির ভাষ্যকার, আবার সংস্কৃতি সাহিত্যের প্রাণরস। একটি জাতির জীবনচর্চা, স্বপ্ন, সংকট, সংগ্রাম, সৃষ্টিশীলতা ও আত্মপরিচয়—সব কিছুই এই দুইয়ের মধ্যে সংরক্ষিত থাকে। আজকের দিনে যখন প্রযুক্তি, বৈশ্বিক চাপ এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে, তখন সাহিত্য-সংস্কৃতির শক্তি আমাদের আত্মপরিচয়ের রক্ষাকবচ হতে পারে। এই যুগে প্রয়োজন এমন সাহিত্যচর্চা যা আমাদের সংস্কৃতির গভীরতা বজায় রেখে আধুনিক বাস্তবতাকে গ্রহণ করে। কারণ সাহিত্য যদি হৃদয়ের ভাষা হয়, তবে সংস্কৃতি সেই হৃদয়ের ছন্দ। তাই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বলাই যায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি শুধু এক ও অবিচ্ছেদ্য নয়, বরং তারা একটি জাতির অস্তিত্বের মৌলিক শিকড়।
প্রবাসী লেখকের সাহিত্যেও সংস্কৃতির চিহ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশে বাস করেও তাঁরা তাঁদের শিকড়, ঐতিহ্য ও জাতিগত পরিচয় খুঁজে ফেরেন সাহিত্যের মাধ্যমে। ঝরনা ধারা চৌধুরী, তাহমিনা আনাম বা ঝুম্পা লাহিড়ীর মতো প্রবাসী লেখকেরা তাঁদের লেখায় পশ্চিমা বাস্তবতার মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির টানাপোড়েনকে তুলে ধরেন। ঞযব ঘধসবংধশব উপন্যাসে ঝুম্পা লাহিড়ী দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রবাসীদের পরিচয় সংকট ও সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি তুলে ধরেন যা অভিবাসী জীবনের বাস্তব চিত্র। এই সাহিত্যগুলো বৈশ্বিক পাঠকের কাছে একটি জাতির সংস্কৃতিকে তুলে ধরার সেতু তৈরি করে, এবং একই সঙ্গে বিশ্বায়নের যুগে ব্যক্তিগত সংস্কৃতি রক্ষার সংকটকেও উন্মোচন করে।
লোকসংস্কৃতি মূলত সাধারণ মানুষের জীবনের সৃজনশীল প্রকাশ। এই সংস্কৃতি সাহিত্যে প্রবাহিত হয়ে এসে কেবল রচনা নয়, জাতির ঐতিহাসিক স্মৃতির সংরক্ষক হিসেবেও কাজ করে। নকশিকাঁথার মাঠ (জসীমউদ্দীন) একটি কবিতা হলেও এতে গ্রামীণ নারীর জীবন তার বেদনা ও শিল্পচর্চার চমৎকার সাংস্কৃতিক রূপায়ণ রয়েছে। মৌলভীবাজারের পুথি সাহিত্য বা সিলেট অঞ্চলের গীতি সবই লোকসংস্কৃতিকে সাহিত্যের মাধ্যমে সংরক্ষণ করেছে। সাহিত্য যদি সমাজের চেতনাকে ধারণ করে, তাহলে লোকসাহিত্য হল সেই চেতনার প্রাণভাষা। ধর্মও একটি সাংস্কৃতিক কাঠামো এবং সাহিত্য বহু সময়েই ধর্মীয় মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান বা ধর্মীয় সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজকে ব্যাখ্যা করেছে। লালন ফকিরের গান আধ্যাত্মিকতা, মানবধর্ম, অসাম্প্রদায়িক ভাবনা এবং বাউল সংস্কৃতিকে সাহিত্যের স্তরে নিয়ে গেছে। রুমির কবিতা বা হাফিজের গজল এসব ইসলামী সংস্কৃতির গহীন দিক তুলে ধরেছে যা বিশ্বসাহিত্যে অনন্য উচ্চতায় অবস্থান করে। এ ধরনের সাহিত্য মানুষের আত্মা ও সংস্কৃতির মধ্যকার সংযোগের প্রতিচ্ছবি। বর্তমান সময়ে পরিবেশ ও প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সাহিত্যে সংস্কৃতির নতুন দিক উঠে এসেছে। যাকে বলা হয় ইকোলজিকাল লিটারেচার বা পরিবেশ-সাহিত্য। হেলেন কেনেডি, আরুন্ধতী রায় বা বাংলা সাহিত্যে হাসান আজিজুল হকের লেখায় পরিবেশ সংক্রান্ত সচেতনতা দেখা যায়। নদী, পাহাড়, বন এসব কেবল প্রাকৃতিক উপাদান নয় বরং একটি সংস্কৃতিরও অংশ। সাহিত্য সেই সংযোগকে সামনে আনে। প্রকৃতি-সংস্কৃতি-সাহিত্যের এই ত্রিভুজ সম্পর্ক সমকালীন সাহিত্যের একটি নতুন মাত্রা। ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং একটি সংস্কৃতির মৌলিক ভিত্তি। সাহিত্য সে ভাষাকে জীবন্ত রাখে এবং সংস্কৃতির বাহক হিসেবে কাজ করে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন একদিকে রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের সংগ্রাম, অপরদিকে সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন। এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত সাহিত্যে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে কবিতা, গল্প, নাটকে। সাহিত্য যদি মাতৃভাষায় রচিত না হয়, তবে একটি জাতির সংস্কৃতি ও চেতনা বিকশিত হতে পারে না। সাহিত্যিক ভাষার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতির পরিবর্তনও ধরা পড়ে। বর্তমান যুগে সাহিত্য ও সংস্কৃতি নানা সংকটে নিমজ্জিত। তবে সংকটের মধ্যেই সম্ভাবনা নিহিত থাকে। জনপ্রিয়তাকেন্দ্রিক সাহিত্য (ঢ়ড়ঢ় ষরঃবৎধঃঁৎব) অনেক সময় গভীরতা হারাচ্ছে। টিভি, ওয়েব সিরিজ ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে সাহিত্যের পাঠক সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বাস্তবধর্মী সাহিত্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি যথাযথভাবে উঠে না আসার অভিযোগও রয়েছে। সাহিত্য আজ অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক। নারী, লিঙ্গ-সংখ্যালঘু, আদিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সাহিত্যচর্চায় সম্পৃক্ত হচ্ছেন। অনলাইন সাহিত্যের বিকাশ নতুন লেখকদের জন্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে। সাহিত্য এখন আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে বৈচিত্র্যকে উদযাপন করছে। বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিক সাফল্য একদিকে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে শক্তিশালী করেছে, অন্যদিকে বিশ্বের কাছে বাংলা সংস্কৃতিকে পৌঁছে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করে। তাহমিনা আনাম, জয়া মিত্র, মোমিনুল আজহার মতো লেখকের ইংরেজিতে রচিত সাহিত্য বাংলা সংস্কৃতির বহির্বিশ্বে সেতুবন্ধ তৈরি করছে। সাহিত্যই সেই মাধ্যম যার মাধ্যমে একটি জাতির সংস্কৃতি ভৌগোলিক সীমার বাইরে বিস্তৃত হতে পারে।
একটি জাতির অস্তিত্ব, আত্মপরিচয় ও ঐতিহ্য নির্ভর করে তার সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর। সাহিত্য কেবল মুদ্রিত কিছু শব্দ নয়, বরং একটি সময়ের মনোভঙ্গি, সংস্কৃতির বহমানতা ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। সংস্কৃতি কেবল রীতি-নীতি নয়, বরং তা জীবনের রং, ছন্দ ও দর্শন। এই দুইয়ের পারস্পরিক নির্ভরতা এবং শক্তিশালী বন্ধন মানবসভ্যতাকে করে তুলেছে সৃষ্টিশীল, সংবেদনশীল ও সচেতন। সাহিত্য ও সংস্কৃতি এই দুই ধারাই আমাদের ইতিহাস, আত্মমর্যাদা ও মানবিক মূল্যবোধের বাহক। এদের বিকাশ ও সংরক্ষণ কেবল নীতিগত দায়িত্ব নয় বরং জাতিগত দায়িত্বও বটে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি একে অপরের পরিপূরক, সমান্তরাল ও অবিচ্ছেদ্য। সাহিত্যই সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করে, আর সংস্কৃতিই সাহিত্যের প্রাণ জোগায়। মানবজীবনের গভীরতম অনুভূতি, সংগ্রাম, স্বপ্ন ও বোধ এই দুইয়ের সমন্বয়ে ফুটে ওঠে। ভবিষ্যতের সমাজ ও প্রজন্মকে পথ দেখাতে হলে সাহিত্য-সংস্কৃতির এই বন্ধনকে আরও মজবুত করতে হবে—তবে শুধুই রক্ষণশীল নয়, বরং সৃজনশীলতা, উদারতা ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে। কারণ সাহিত্য-সংস্কৃতিই একটি জাতিকে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, অমর করে রাখতে পারে তার আত্মপরিচয়।
লেখক পরিচিতি : উজ্জ্বল হোসাইন, প্রাবন্ধিক, চাঁদপুর।