
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগামী ১ জুন শুরু হচ্ছে ১৯ দিনের ছুটি। কর্তৃপক্ষ বলছে, শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী ঈদুল আজহা ও গ্রীষ্মকালীন অবকাশ। অভিভাবকরা বলছেন, দীর্ঘ ছুটিতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। বিকল্প উপায়ে পড়তে পারে না, এমন শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে।
শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন পাঠ্যবই হাতে না পাওয়ায় শিক্ষাবর্ষের প্রথম দুই মাস গেছে পড়াশোনা ছাড়া। তৃতীয় মাস (২ মার্চ শুরু) থেকে রোজাসহ ৪০ দিনের ছুটি ছিল। খোলার পর দু’দিন ক্লাস পেয়েছিল শিক্ষার্থীরা। এরপর শুরু হয় এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা; যা এখনও চলছে। আসছে ঈদুল আজহা ও গ্রীষ্মকালীন ছুটির পর আবার শুরু হবে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা জানান, ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের বেশির ভাগ বড় ছুটি পড়ে গেছে বছরের প্রথমার্ধে। এতে তারা সিলেবাস শেষ করা নিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন। কারণ ‘অ্যাকটিভ ক্লাসরুম টাইম’ পাওয়া তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
অভিভাবকরা বলছেন, বিদ্যালয় খোলা না থাকলে সন্তান শুয়েবসে সময় কাটায়। পড়াশোনায় মনোযোগ থাকে না। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সন্তানদের কোচিং সেন্টার বা শিক্ষকের কাছে ব্যাচে পড়ান। এতে শিক্ষাব্যয় বাড়ে। আবার গ্রামের অভিভাবকদের সামর্থ্য না থাকায় সন্তানরা খেলাধুলা করে ছুটি কাটায়। ফলে তারা জ্ঞান অর্জনে পিছিয়ে পড়ছে।
গত বছর জুলাই আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কিছুদিন কার্যত অচল হয়ে পড়ে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানকে জোর করে পদত্যাগ করানো হয়। আগস্টজুড়েই বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা বিরাজ করে। সেপ্টেম্বর থেকে পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়।
শিক্ষকরা জানান, বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি স্বাভাবিক। তবে চাকরি হারানো শিক্ষকদের স্থলে নতুন নিয়োগ হয়নি। এতে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একাডেমিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। পদবঞ্চিত প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও শিক্ষক জোটের আহ্বায়ক আনোয়ারুল ইসলাম তালুকদার সমকালকে বলেন, গত ৫ আগস্টের পর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত বহু খ্যাতনামা অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকদের অপমান, অপদস্ত, হেনস্তা ও মারধর করে জোরপূর্বক পদত্যাগ, অপসারণ, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক ছুটি, কর্মস্থলে প্রবেশে বাধাসহ অনেকের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের হিসাবে এ সংখ্যা তিন সহস্রাধিক। তারা পদবঞ্চিত হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। এই হয়রানি ও বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
দেখা যায়, পাবলিক পরীক্ষার কারণেও অস্বাভাবিক ক্লাস বন্ধের সমস্যা রাজধানীর বড় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এই বন্ধ আবার ছুটি হিসেবে ধরা হয় না। সরকারি-বেসরকারি মাধ্যমিক ও নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ছুটির তালিকায় এসএসসি পরীক্ষার সময় ক্লাস বন্ধের কথা নেই। এ বছরের তালিকায় ৭৬ দিন ছুটি রয়েছে। বাস্তবে ছুটি আরও বেশি।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর খ্যাতনামা ও বড় প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র রয়েছে। স্কুল অ্যান্ড কলেজগুলোতে এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষার সময় ক্লাস বন্ধ থাকছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ফেরদাউস বলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষার সময় আমাদের শাখা ক্যাম্পাসগুলোতে ক্লাস নেওয়া হয়। মূল ক্যাম্পাসে পরীক্ষার ফাঁকে ফাঁকে ক্লাস নেওয়া হয়।’
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাজেদা বেগম বলেন, লম্বা ছুটিতে নির্দিষ্ট সিলেবাস শেষ করা চ্যালেঞ্জের। আমরা চেষ্টা করি, ছাত্রীদের যেন ক্ষতি না হয়। তারা যেন সিলেবাস শেষ করতে পারে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার জানান, যেদিন এসএসসি পরীক্ষা থাকবে না, সেদিন ক্লাস নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঈদুল আজহা ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলবে ১ থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত। সরকারি-বেসরকারি কলেজে এই ছুটি চলবে ৩ থেকে ১২ জুন পর্যন্ত। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩ থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত ছুটি চলবে।
এদিকে আগামী ১৭ ও ২৪ মে (দুই শনিবার) স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। ওই দুই দিন সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি অফিস খোলা রাখার নির্দেশনাও রয়েছে।
দীর্ঘ ছুটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। রাজধানীর একটি বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মুনিরাতুল হক অর্থি জানায়, ছুটি আমাদের ভালো লাগে। তবে দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকলে ভালো লাগে না। কারণ এতে একদিকে পড়াশোনার অপূরণীয় ক্ষতি হয়; আবার লম্বা ছুটির কারণে অনেক পড়া জমে যায়।
মিরপুরের মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল আলম আসিফের মন্তব্য হলো, স্কুল খোলা থাকলে ভালো। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়। নইলে বাসায় টিভি দেখে, মোবাইল ফোনে গেমস খেলে বিরক্তিকর সময় কাটে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ‘শিক্ষার হালচাল ও আগামীর ভাবনা’ শীর্ষক এক পরামর্শ সভায় গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ মাসের চিত্র তুলে ধরা হয়। তিনি জানান, মোট ৪২৭ দিন। খোলা ছিল ১৪৮ দিন। বন্ধ ছিল ২৭৯ দিন।
এ বিষয়ে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে, নিয়মিত ক্লাস হলেও যেখানে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, সেখানে লম্বা সময় বন্ধ থাকলে পরিস্থিতি কি দাঁড়ায় তা সহজে অনুমেয়। ব্যাপক শিখন ঘাটতি তৈরি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এ ঘাটতি পূরণে সরকারের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আজাদ খান বলেন, শিক্ষাপঞ্জি অনুসরণ করে সিলেবাস সাজানো হয়। অস্বাভাবিক ছুটির কারণে কোনো শিখন ঘাটতি তৈরি হলে প্রয়োজনে ছুটির দিনে বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করে হলেও তা মেটানো হবে।
আপনার মতামত লিখুন