
নিম্নবিত্ত পরিবারে মা-বাবার ভরণপোষণে সামর্থ্য থাকে না। মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলেমেয়ে বিয়ের পর আলাদা হয়ে যায়। অনেকের সন্তান বিদেশে চলে যায়। ফলে প্রবীণ ব্যক্তিদের একাকিত্ব বাড়ছে।
বিশ্ব প্রবীণ দিবস উপলক্ষে গতকাল রোববার সকালে বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেনস ওয়েলফেয়ার সোসাইটির আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর সোবহানবাগে ড্যাফোডিল প্লাজার একাত্তর মিলনায়তনে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও আয়োজক সংগঠনের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
বিশ্বব্যাপী প্রবীণ দিবস পালিত হয় ১ অক্টোবর। তবে শারদীয় দুর্গাপূজার কারণে বাংলাদেশে এবার পালিত হয় ৫ অক্টোবর। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দিবসটির প্রতিপাদ্য করেছে– ‘একদিন তুমি পৃথিবী গড়েছো, আজ আমি স্বপ্ন গড়বো, সঙ্গে তোমায় রাখবো আলগে’। গতকালের সভায় বক্তারা জানান, বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু এখন প্রায় ৭২ বছর। দেশের ৬০ বছর বা তার ঊর্ধ্ব বয়স এমন মানুষের হার বর্তমানে প্রায় ১১ শতাংশ। এটা ২০৫০ সালের মধ্যে ২২ শতাংশে পৌঁছাবে। তিন দশকের মধ্যে প্রবীণদের সংখ্যা দাঁড়াবে তিন কোটি ৬০ লাখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বয়স বাড়তে থাকা এই জনগোষ্ঠীর সামনে যেমন শারীরিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে আর্থিক, সামাজিক এবং পারিবারিক সুরক্ষার সংকট। পরিবার কাঠামো, জনসংখ্যাগত পরিবর্তন এবং অসংক্রামক রোগের কারণে প্রবীণদের জীবনযাত্রা ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাই সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
সভায় প্রয়াত প্রবীণ ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. এম শমশের আলী, ড. আমিরুল ইসলাম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল হারুনুর রশীদ (বীরপ্রতীক) ও ইঞ্জিনিয়ার মো. ফজলুল হকের স্মরণে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক ড. গোলাম শওকত হোসেন।
‘বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ: নিঃসঙ্গতা থেকে বৈষম্য প্রসঙ্গে’ মূল প্রবন্ধে জানানো হয়, প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে প্রবীণদের বড় অংশ পিছিয়ে পড়ছে। এটা তৈরি করছে ‘গ্রে ডিজিটাল ডিভাইড’। অর্থনৈতিক দিক থেকেও তারা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। সরকারি বয়স্কভাতা (৫০০-৬০০ টাকা) প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অধিকাংশ প্রবীণ বেসরকারি খাত বা অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে কাজ করায় অবসরের পর তাদের স্থায়ী আয় থাকে না।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘ঢাকা শহর এখন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রবীণ-অবান্ধব শহরগুলোর একটি। এখানে সুস্থ মানুষ হাঁটতে পারে না, প্রবীণরা কীভাবে হাঁটবে? পার্ক, বসার জায়গা, উন্মুক্ত স্থান– হারিয়ে যাচ্ছে। অ্যাপার্টমেন্ট সংস্কৃতিতে প্রবীণরা ঘরবন্দি। রোদে যাওয়া, হাঁটা– এসবের সুযোগ নেই। অথচ প্রবীণদের সুস্থ থাকার জন্য রোদ ও শারীরিক নড়াচড়া জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রবীণদের সংকট কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও মানসিক দুটোই। সরকারি পর্যায়ে প্রবীণদের জন্য শিশু ও নারীদের মতো আলাদা নীতিমালা নেই। আমাদের উচিত এই বিষয়ে নতুন করে ভাবা।’ সভাপতির বক্তব্যে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘জেরিয়াট্রিক মেডিসিন (বার্ধক্যবিদ্যা) গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। পাশাপাশি কেয়ারগিভিংও (যত্ন নেওয়া) বিশাল অর্থনৈতিক খাত। এখানে মান নির্ধারণ দরকার। এখন অনেক সাবস্ট্যান্ডার্ড সেবা চলছে। সোসাইটি চাইলে এ খাতে নীতিনির্ধারণ ও মান নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রবীণদের নিয়ে আলোচনায় অনেক সময় নারীরা হারিয়ে যান। অথচ তাদের সমস্যাগুলো আলাদা ও জটিল- স্বাস্থ্য, সামাজিক অবস্থান, নিরাপত্তা ও আর্থিক দিক থেকে।’ এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম, সোসাইটির সহসভাপতি প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূঁইয়া, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. অধ্যাপক জি এম ফারুকী, নজরুল গবেষক আতা উল্লাহ খান, ড. শরীফা বেগম প্রমুখ বক্তব্য দেন।
আপনার মতামত লিখুন