এআই দিয়ে চুপিসারে কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের ভিডিও এডিট


কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের অনুমতি ছাড়াই কিছু ভিডিওতে গোপনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে পরিবর্তন এনেছে ইউটিউব। বিষয়টি নজরে আসার পর সৃষ্ট হয়েছে ব্যাপক আলোচনা ও উদ্বেগ। অনেক ইউটিউবার বলছেন, ভিডিওগুলো দেখতে এখন এমন লাগছে যেন বাস্তবতা নয়, কোনো এআই কনটেন্ট।
মার্কিন ইউটিউবার রিক বিআটো বললেন, ‘আমি ভাবলাম, আমার চুলটা কেমন অদ্ভুত লাগছে, আর মুখটাও যেন কেউ মেকআপ করে দিয়েছে।’ ভিডিওর সূক্ষ্ম পরিবর্তন বুঝতে তাঁর সময় লেগেছে। উল্লেখ্য, বিআটোর চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৫০ লাখের বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে ইউটিউব চুপিচুপি কিছু ভিডিওতে এআই ব্যবহার করে শার্টের ভাঁজকে আরও স্পষ্ট, ত্বককে কোথাও আরও মসৃণ আবার কোথাও আরও তীক্ষ্ণ করে তোলে। কারও কারও কান লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেগুলো কিছুটা বিকৃত। এ পরিবর্তন এতটাই সূক্ষ্ম যে আলাদা করে না দেখলে বোঝা যায় না।
সংগীতভিত্তিক আরেক জনপ্রিয় ইউটিউবার রেট শুলও তাঁর ভিডিওতেও অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘যতই দেখছি, ততই বিরক্ত লাগছে। আমি চাইলে নিজের মতো করে ভিডিও শার্প বা স্পষ্ট করতে পারতাম। ভিডিওগুলো দেখলে মনে হয় এআই দিয়ে তৈরি। আমার দর্শকদের সঙ্গে আমার যে বিশ্বাসের সম্পর্ক, এটা তা ক্ষুণ্ন করছে। এটা আমাকে ভীষণভাবে বিরক্ত করছে।’
এমন অভিযোগ শুধু বিআটো বা শালের নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত জুন থেকেই এমন অভিযোগ উঠে আসছে। কেউ কেউ কাছ থেকে স্ক্রিনশট নিয়ে দেখিয়েছেন, তাঁদের মুখের বা শরীরের অংশ কেমন যেন বিকৃত। তখনো নিশ্চিত ছিল না, ইউটিউব কি আসলেই কিছু করছে কি না।
অবশেষে বিষয়টি স্বীকার করেছে ইউটিউব। তারা বলছে, শুধু ইউটিউব শর্টসের কিছু ভিডিওতে পরীক্ষামূলকভাবে এআই ব্যবহার করা হচ্ছে।
এক্স-এ দেওয়া পোস্টে ইউটিউবের সম্পাদকীয় ও নির্মাতা লিয়াজোঁ প্রধান রেনে রিচি লেখেন, ‘আমরা কিছু ইউটিউব শর্টসে প্রচলিত মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে ভিডিও প্রসেসিংয়ের সময় আনব্লার, ডিনয়েজ এবং ক্ল্যারিটি উন্নত করার পরীক্ষা চালাচ্ছি। স্মার্টফোনে যেভাবে ভিডিও রেকর্ডিংয়ের সময় প্রক্রিয়াকরণ হয়, বিষয়টি অনেকটা সেরকম।’
তবে ইউটিউব বিবিসির প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্ট করে বলেনি, নির্মাতাদের সম্মতি ছাড়া এআই ব্যবহারের বিষয়টি ভবিষ্যতেও চলবে কি না।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটা সাধারণ স্মার্টফোন প্রসেসিংয়ের মতো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজইনফরমেশন স্টাডিজের অধ্যাপক স্যামুয়েল উলি বলেন, ‘স্মার্টফোনে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কোন ফিচার চালু রাখবেন। তবে এখানে দেখা যাচ্ছে, ইউটিউব নির্মাতাদের না জানিয়ে এবং অনুমতি না নিয়েই তাদের কনটেন্ট পরিবর্তন করছে। এটা দর্শকদের সামনে এমন এক বাস্তবতা হাজির করছে যা নির্মাতার ইচ্ছার প্রতিফলন নয়।’
তিনি বলেন, ইউটিউবের পক্ষ থেকে ‘মেশিন লার্নিং’ শব্দটি ব্যবহার করার মধ্যেও কৌশল রয়েছে। কারণ, মেশিন লার্নিং আসলে এআই-এরই একটি উপধারা। ইউটিউব হয়তো ‘এআই’ শব্দটি ব্যবহার না করে আতঙ্ক এড়াতে চেয়েছে।
রিচি আরও বলেন, তারা মূলত জেনারেটিভ এআই নয়, বরং প্রচলিত মেশিন লার্নিং ব্যবহার করছে। তবে অধ্যাপক উলি বলেন, এ দুইয়ের ব্যবধান এখানে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মূল বিষয় হলো—ইউটিউব এমন কিছু পরিবর্তন করছে, যা দর্শক বা নির্মাতাদের অজান্তেই বাস্তবতাকে বদলে দিচ্ছে।
এটা শুধু ইউটিউব নয়। ২০২৩ সালে স্যামসাং ধরা পড়ে, তারা নাকি চাঁদের ছবি এআই দিয়ে উন্নত করছে। পরে প্রতিষ্ঠানটি বিষয়টি স্বীকার করে এবং প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে, সে বিষয়ে একটি ব্লগপোস্ট প্রকাশ করে।
এদিকে, গুগল পিক্সেল ফোনের ‘বেস্ট টেক’ ফিচার তো আরও এগিয়ে গেছে। একাধিক গ্রুপ ছবির মধ্যে সব মানুষের সবচেয়ে সুন্দর এক্সপ্রেশনগুলো বেছে নিয়ে একটি ‘আদর্শ মুহূর্ত’ তৈরি করে দেয়—যা বাস্তবে কখনো ঘটেনি। এমনকি পিক্সেল ১০–এর একটি ফিচার জেনারেটিভ এআই দিয়ে ১০০ গুণ পর্যন্ত জুম করতে পারে। যেটা ক্যামেরার প্রকৃত সীমা ছাড়িয়ে যায়।
এই প্রযুক্তিগুলোর ফলে প্রশ্ন ওঠে, আজকের ছবি বা ভিডিও আসলে কী তুলে ধরে?
প্রযুক্তি বিশ্লেষক উলি বলছেন, এটি নতুন কিছু নয়। ৩০ বছর আগে ফটোশপ যখন জনপ্রিয় হচ্ছিল, তখনো এমন উদ্বেগ ছিল। এরপর এসেছে এয়ারব্রাশিং, বিউটি ফিল্টার—সবই একরকম বাস্তবতার বিকৃতি।
গুগলের প্রকৌশলীরা বিষয়টি উপলব্ধি করছেন বলেই সম্ভবত পিক্সেল ১০ ফোনে নতুন কনটেন্ট ক্রেডেনশিয়াল যুক্ত করা হয়েছে—যা এআই ব্যবহৃত হলে ছবিতে ডিজিটাল ওয়াটারমার্ক বা জলছাপ দিয়ে তা জানিয়ে দেয়।
তবে নির্মাতাদের না জানিয়ে ভিডিও বদলে ফেলার ইউটিউবের এই সিদ্ধান্ত অনলাইন কনটেন্টের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
উলি বলেন, ‘এটি দেখায়, কীভাবে এআই ধীরে ধীরে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে উঠছে, আমাদের বাস্তবতার পর্দা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মানুষ তো এমনিতেই সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্ট নিয়ে সন্দিহান। এখন যদি জানতে পারে, কোম্পানিগুলোও ওপর থেকে কনটেন্ট পরিবর্তন করছে, নির্মাতাদের না জানিয়ে—তাহলে বিশ্বাস কোথায় থাকবে?’
তবে সবাই আবার এ নিয়ে বিরক্ত নন। রিক বিআটো বলেন, ‘শোনো, ইউটিউব তো সব সময় নতুন কিছু নিয়ে কাজ করে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। তারা সেরা মানের কোম্পানি। ইউটিউব আমার জীবন বদলে দিয়েছে।’
আপনার মতামত লিখুন